এসবিএন ডেস্ক:
শিশুদের জন্য ঢাকা ক্রমেই অনিরাপদ বাসস্থানে পরিণত হতে চলেছে। নানা অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বহীনতা, অসচেতনতায় যেখানে সেখানে জলাবদ্ধতা, হাজারীবাগের বিষাক্ত ট্যানারি পল্লী, পুরান ঢাকার যত্রতত্র কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম, ক্ষতিকর সিসাযুক্ত ধোঁয়া-ধুলির রাজধানী নগরীতে সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে না আগামী প্রজম্ম।
পরিবেশ বিপন্নতার বেহাল পরিস্থিতি ছাড়াও রাজধানীর পদে পদে পাতা আছে মৃত্যুফাঁদ। মহল্লার অলিগলি পর্যায়েও ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল, খোলা ড্রেন, গভীর-অগভীর খানাখন্দক, গর্ত, নিরাপত্তা বেষ্টনীবিহীন নির্মাণ কর্মকাণ্ড, নর্দমা-খালগুলো শিশুদের জন্য তো বটেই, বড়দের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শাহজাহানপুর রেল কলোনিতে গভীর নলকুপের অরক্ষিত পাইপের মধ্যে পড়ে শিশু জিহাদের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর গত মঙ্গলবার শ্যামপুরের পালপাড়ায় নর্দমার বিষজলে প্রাণ গেল আরেক শিশু নীরবের। মাঝে মুগদা মাণ্ডার খোলা স্যুয়ারেজ খালে পড়ে করুণ মৃত্যু ঘটে আরও দুজনের। এসব মৃত্যুফাঁদকে বিপদমুক্ত রাখার উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের। নিশ্চিত বিপদের এ স্থানগুলো উম্মুক্ত থাকছে মাসের পর মাস। ঢাকা ওয়াসা, দুই সিটি করপোরেশন ও তিতাস গ্যাস বিভাগের আওতায় থাকা এসব মৃত্যুফাঁদ ওঁত পেতে আছে রাজধানীর রাস্তাঘাট, অলিগলির কোণে কোণে।
শিশুদের জীবন কেড়ে নেওয়ার মতো আরেকটি পাইপের দেখা পাওয়া গেছে সচিবালয়ের কোণে। এ ছাড়া নূর হোসেন স্কয়ার সংলগ্ন সচিবালয়ের উত্তর-পূর্ব কোণে ফুটপাথের ওপর একটি মোটা আকৃতির পাইপ খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। রাজধানীতে ডিপ টিউবওয়েল স্থাপনের জন্য ওয়াসার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবৈধভাবে ডিপ টিউবওয়েল স্থাপনকালে এ ধরনের মৃত্যুফাঁদ গড়ে ওঠে।
গোপীবাগসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে স্যুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার কিংবা গ্যাসলাইন মেরামত কাজ করতে গিয়ে অন্তত ১৩ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। জানা যায়, রাজধানীর আন্ডারগ্রাউন্ড লাইনগুলোতে ময়লা-আবর্জনা জমে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেসব স্থানে ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, তিতাস গ্যাস ও বিটিসিএল কর্তৃপক্ষ আনাড়ি শ্রমিকদের নামিয়ে নানা রকম কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে শ্রমিকদের নিযুক্ত করা হলেও সতর্কতামূলক অক্সিজেন মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, মাথার হেলমেট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয় না। ফলে প্রায়ই মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে।
ওয়াসার কথিত বক্স কালভার্টগুলোও সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। ফকিরাপুল-বাংলাদেশ ব্যাংক-মানিকনগর হয়ে যে বক্স কালভার্টটি বাসাবো কদমতলী পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে, এর অনেক স্থান বক্স কালভার্ট নির্মাণহীন অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। নগরীর ভাটারা থানার অদূরে ক্যামব্রিয়ান কলেজের ঠিক পেছনের ব্যস্ততম রাস্তার ওপরেই বিপজ্জনক খোলা নর্দমা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বাসিন্দাদের আতঙ্কের কারণ হয়ে আছে। ভাটারার জে ব্লক, নূরেরচালা, খিলবাড়ীরটেক, শাহজাদপুরের একাংশে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ড্রেন, নর্দমা, খোলা স্যুয়ারেজ ও ম্যানহোলের সংখ্যা অর্ধশতাধিক।
ডিএসসিসি ও ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার মোট ৩২ হাজার ৫৯৮টি ম্যানহোল রয়েছে। এর মধ্যে ডিএসসিসির ১৪ হাজার ২৪০টি ও ওয়াসার ১৮ হাজার ৩৫৮টি ম্যানহোল রয়েছে। ডিএসসিসির খাতাপত্রে মাত্র ৩৪টি ও ওয়াসার রেকর্ডে মাত্র ৫৭টি ম্যানহোলের কভার নেই বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ওই হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
দেখা গেছে, অন্তত অর্ধেক ম্যানহোলই পড়ে আছে ঢাকনাবিহীন অবস্থায়। ডিসিসি ও ওয়াসা ছাড়াও বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি (বিটিসিএল) ও তিতাস গ্যাস কোম্পানির ম্যানহোল রয়েছে। গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, সামিট গ্রুপসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নানা সংযোগ লাইন নির্মাণকালেও বিভিন্ন স্থানে ম্যানহোল তৈরি হয়েছে। ফকিরেরপুল, মতিঝিল, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, মালিবাগ, মগবাজার, রামপুরা, বাড্ডা, বাসাবো, গোড়ান, তালতলা, শান্তিনগর, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, রাজারবাগ, মুগদা, জুরাইন, গোপীবাগ, শহীদবাগ, কদমতলা, সবুজবাগ, লালবাগ, শহীদ নগর, ইসলামবাগ, চকবাজার, নয়াবাজার, সূত্রাপুরসহ পুরান ঢাকার সরু অলিগলির অধিকাংশ রাস্তার ম্যানহোলে ঢাকনা নেই। তাছাড়া রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ও ধানমণ্ডির রাস্তাগুলোর অধিকাংশে ম্যানহোলেরও ঢাকনা নেই। সেখানকার বাসিন্দারা নিজ উদ্যোগে লাঠির মাথায় লাল কাপড় খণ্ড লাগিয়ে ম্যানহোলগুলোতে টানিয়ে রাখেন।
সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর ওয়ারীর বলদা গার্ডেনের সামনের সড়কটির বেহাল অবস্থা। সেখানেও ম্যানহোলের ঢাকনা ভেঙে পড়ে আছে অনেক দিন ধরে। বলদা গার্ডেনে প্রবেশের মূল ফটকের ঠিক সামনে সিমেন্টের ম্যানহোলের একটি অংশ ভাঙা। বের হয়ে আছে বেশ কয়েকটি রড। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজে ভারী ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার হওয়ায় এসব যন্ত্রের চাপ বক্স ড্রেনগুলো সহ্য করতে পারছে না। সেগুলো ভেঙে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কাজ করতে গিয়ে কোনো ড্রেন, ম্যানহোল বা ড্রেনবক্স ভেঙে ফেললে সেগুলো মেরামত করে দেবে, নইলে ক্ষতিপূরণ দেবে। আমরা সেটা মেরামত করব। কিন্তু বর্তমানে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এলজিইডি কোনো ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না। রাজধানীর ইস্কাটনে ইস্পাহানী মহিলা কলেজের বিপরীতে শামসুদ্দীন ম্যানশনের পাশের মূল সড়ক সংলগ্ন গলির ঠিক মাথায় দেখা যায় আনুমানিক চার থেকে পাঁচ ফুট গভীরের একটি গর্ত। গর্তটির ভিতরে ময়লা ও নোংরা পানি। গর্তের পাশ দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পথ চলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। মৌচাক মার্কেটের পাশেই গোল্ডেন টাওয়ারের সামনে প্রায় চার মাস ধরে খোলা অবস্থায় আছে আরেকটি গর্ত।
পদে পদে মৃত্যু ঝুঁকি : ড্রেন, খোলা নর্দমা, ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল কিংবা গভীর পাইপ-ই শুধু যে শিশুসহ পথচারীদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তা নয়, মৃত্যুর হাতছানি আছে আরও অনেক। পুরান ঢাকার ১০ থানা এলাকায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ২৫ হাজার কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম, অতি সরু অলিগলি পেরিয়ে ৭০ ভাগ বাড়িঘর পর্যন্ত পৌঁছে না অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। বাসাবাড়ির বারান্দা বা ঠিক গেটের সামনেই বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকে বৈদ্যুতিক তার, জনবহুল রাস্তার মাঝেই খোলা আছে জোড়াতালির বিদ্যুৎ সংযোগ, ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল- এমন হাজারো বিপদ যেন পদে পদে। হাজারীবাগের ট্যানারি যেমন পুরান ঢাকার বড় অভিশাপ তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ দুই সহস্রাধিক বাড়ি নিয়েও পুরান ঢাকাবাসীর সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা; এই বুঝি তা মাথায় ভেঙে পড়ে। প্রায় দুই পাশ ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা নদী সেখানে বিষ ছড়ায়, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প পাশাপাশি গলাগলি অবস্থান মিলিয়ে গড়ে উঠেছে ‘মৃত্যু ফাঁদ-পুরান ঢাকা।’ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, পুরান ঢাকার ৮০ শতাংশ বসতবাড়িতে নানা ধরনের বিপজ্জনক দাহ্য রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম বানানো হয়েছে। সেসব কারখানায় সালফার, পটাশ, ফসফরাস, সালফিউরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড, ইথানল, মিথাইল, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, ফরমালডিহাইড, এডহেসিভ বা সলিউশন, তারপিনসহ নানা ধরনের গানপাউডার-বিস্ফোরকের অবাধ ব্যবহার চলছে। এসবই মৃত্যুফাঁদ, প্রাণ কেড়ে নেওয়ার বড় হুমকি। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন