সিলেট বাংলা নিউজ ডেস্কঃ বেগুনের সফল রপ্তানির পথ ধরে এবার ইউরোপের দেশে দেশে যাবে টাঙ্গাইলের মধুপুরে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদিত করলা, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়স, মরিচ। এতে চাষি পর্যায়ে ভাগ্য বদলের পাশাপাশি দেশের রপ্তানি আয়ের নতুন দিগন্ত খুলে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের ধারণা, যদিও খানিকটা জটিলতায় বেগুন রপ্তানি বন্ধ রাখতে হয়েছে বছর কয়েক। তবে, বিগত ৫/৬ মাসে এই বেগুনেরই সফল রপ্তানির কারণে অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে করলা, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়স ও মরিচসহ এ জাতীয় সবজি রপ্তানিতে।
সংগৃহীত
বিভিন্ন সূত্র মতে, উৎপাদন সংক্রান্ত জটিলতা ও পোকার কারণে বছর কয়েক বেগুন রপ্তানি বন্ধ রেখেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)।
ওই সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ পোকা আক্রান্ত এ সবজিকে মারাত্মক সমস্যাযুক্ত (ক্রিটিক্যাল কমোডিটি) বলে চিহ্নিত করে। ফলে দেশের ভাবমূর্তি অটুট রাখতে সরকার বেগুন রপ্তানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে, ইউরোপ ছাড়া অন্য দেশগুলোতে যথারীতি বেগুন রপ্তানি হতো।
এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সবজি রপ্তানিকারক সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা চুক্তিতে চাষ করে ওই সবজি পুনরায় রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ‘এগ্রিবিজনেজ ফর ট্রেড কমপিটিটিভনেস প্রজেক্ট (এটিসি-পি) নামে একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ইউকে এইড, ডিএফআইডি ও সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন এই প্রকল্পে অর্থায়ন করে।
এতে কারিগরি সহায়তা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিজনেজ প্রমোশন কাউন্সিল (বিপিসি), বিএফভিএপিইএ ও ডিএই। এরপর ইউরোপের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্মত চাষাবাদ করতে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে উৎপাদিত সবজিসহ ফসল রপ্তানির উদ্যোগ বাস্তবায়নে শুরু হয় ওই প্রকল্পের কাজ। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলেই বেগুন রপ্তানির সুদিন ফিরে আসছে।
সংগৃহীত
সূত্রটি জানায়, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে চাষাবাদ ছাড়া কোনো সবজি দেশের বাইরে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উৎপাদনের শুরু থেকে দেশের বাইরের বাজারে পৌঁছানো পর্যন্ত চলবে তদারকি। কোনো স্তরেই ছাড় দেওয়া হবে না। সবজি রপ্তানিতে দেশের ভাবমূর্তি আগের অবস্থায় ফেরাতে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতেই হবে।
এদিকে, বিএফভিএপিইএ, অ্যাগ্রিবিজনেস ফর ট্রেড কমপিটিটিভনেস (এটিসি-পি) প্রোজেক্ট, বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে নির্বাচিত চাষিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের বিষয়ে ধারণা, উদ্বুদ্ধকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
কথা বলে জানা যায়, গত বছরের মধ্য আগস্টে প্রথমত মধুপুরের কুড়াগাছা গ্রামের ১২ জন চাষি এ প্রকল্পের আওতায় সাত একর জমিতে বেগুন চাষ শুরু করেন। শুরু থেকেই মাঠ দিবস, বৈঠক ও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে চাষিদের সঙ্গে কৃষি বিভাগের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারে নিরুৎসাহীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পোকার হাত থেকে গাছ রক্ষা করতে ইস্পাহানী বায়োটেক কোম্পানি কৃষকদের মধ্যে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ সরবরাহ করে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। বায়োডার্মা নামের ওষুধ দিয়ে সাইড মরা (প্যারালাইজ্ড) রোগ থেকে বেগুন গাছকে রক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়।
কৃষি বিভাগের সার্বিক সহযোগিতা ও নানা শর্ত অনুসরণে ‘নন্দিনী’ জাতের হাইব্রিড বেগুন চাষে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন ওই ১২ চাষি। তাদের উৎপাদিত বেগুন দিয়েই ইউরোপে সবজি রপ্তানি ফের চালু হয়।
এই ‘বেগুন-সাফল্যের’ পথ ধরেই সম্প্রতি উপজেলার ভবানীটেকি এলাকার ২৫ জন নির্বাচিত চাষি কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে করলা, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়স, মরিচ, চাল কুমড়া চাষ করে এলাকায় প্রায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তাদের উৎপাদিত সবজিই এখন বিদেশে যাত্রার পথে।
সংগৃহীত
কৃষি অফিস সূত্র জানায় , মধুপুরের মাটি সবজি চাষের উপযোগী। লালমাটির এই উপজেলার গ্রামগুলোতে সম্প্রতি ফল-ফসলের আবাদ হ্রাস পেয়ে সবজির আবাদ বাড়ছে হু-হু করে।
উপজেলার অরণখোলা ইউনিয়নের কুড়াগাছা ভবানীটেকি, চাঁপাইদ, পিরোজপুর, পীরগাছা, মমিনপুর, ধরাটি ও আঙ্গারিয়া, গোলাবাড়ী এবং মির্জাবাড়ি ইউনিয়নের বিশনাইপাল, ব্রাহ্মণবাড়ি, কেতনপুর, আম্বাড়িয়া, হাজিপুর, গোসাইবাড়ী, দূর্গাপুর, পালবাড়ি ও মির্জাবাড়ি সবজির গ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করেছে। কুড়াগাছা ও ভবানীটেকি বাজারেই গড়ে উঠেছে সবজির পাইকারি আড়ৎ।
ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এখান থেকে সবজি ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছেন রাজধানীসহ সারাদেশে। এতে কৃষকরা আর্থিক স্বচ্ছলতা পাচ্ছেন।
বিষয়টি নজরে আসায় এলাকার সবজি কেন্দ্রিক চাষাবাদকে আরও উন্নত করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের পাঁচ জেলার ১০ উপজেলায় ‘প্ল্যান্ট ডক্টর ক্লিনিক’ প্রকল্প চালু করা হয়েছে।
এর আওতায় মধুপুরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মধুপুরে চালু হওয়া ওই ‘প্ল্যান্ট ডক্টর ক্লিনিক’ জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় সবজি চাষে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক উৎসাহ দেখা দিয়েছে।
২৫ চাষির একজন আলমগীর। তিনি আমার সংবাদকে জানান, তিনি এবার ৭ একর জমির মধ্যে ৩ বিঘায় ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা খরচ করে বেগুন চাষ করে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা আয় করেছেন। তার লাভ হয়েছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। যা অন্য কোনো ফসল চাষে কখনও পাননি।
তার মতো বেগুন চাষ করে লাভবান হয়েছেন দেলোয়ার, গোলাম মোস্তফা, চান মামুদ, চান মিয়া, মুন্নাফ, করিম, ফরমান, আব্দুল্লাহ ও শামীমসহ অনেকেই।
টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল হাসিম আমার সংবাদকে জানান, বেগুন চাষ ও রপ্তানির মধ্য দিয়ে এলাকার অন্যান্য সবজি চাষ ও রপ্তানির যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা ধরে রাখতে হবে। তাতে কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এলাকা ও দেশের অর্থনীতিতে।