সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : আমাদের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দ্রুত এবং পুরোপুরি অর্জিত হবে এটা আমরা আশা করিনি; কিন্তু যা ঘটেছে তা মোটেই সন্তোষজনক নয়। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একটি বড় রাষ্ট্রকে ভেঙে ছোট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল না, ছিল মুক্তির; অর্থাৎ এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার যেটি হবে গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিকও। সেদিকে আমরা এগোতে পারিনি। উন্নয়ন যা ঘটেছে তা পুঁজিবাদী ধরনের। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তাই বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে; এবং বৃদ্ধি পেয়েছে শোষণ। সম্পদ সৃষ্টি মেহনতি মানুষের শ্রমে। এবং সেই সম্পদের একাংশ পাচার হয়ে গেছে বিদেশে, অন্য একটা অংশ খরচ হয়েছে ধনিক শ্রেণির ভোগবিলাসে। ব্রিটিশ শাসন ছিল ঔপনিবেশিক; পাকিস্তানি শাসকরাও বাংলাদেশকে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত করতে চেয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও কিন্তু এক ধরনের ঔপনিবেশিকতাই আমরা দেখছি। সেটা দেশীয় বুর্জোয়াদের ঔপনিবেশিকতা। শোষণ এবং সম্পদ পাচার, দুটিই পুরোমাত্রায় চলছে।
নারীর অগ্রগতির ক্ষেত্রে মেয়েরা ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে গেছে ঠিকই; কিন্তু পুঁজিবাদের পিতৃতান্ত্রিকতার অধীনে তাদের নিরাপত্তা বাড়েনি, বরং কমেছে। ধর্ষণ আগেও ছিল, কিন্তু গণধর্ষণের কথা শোনা যেত না, এখন সেটা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। বোরকা ও হিজাবের ব্যাপক প্রচলন মেয়েদের আত্মসমর্পণের স্মারকচিহ্ন বৈকি। এর জন্য দায়িত্ব অবশ্যই বহন করতে হবে রাজনীতিকদের; বুদ্ধিজীবীদেরও কিন্তু দায়িত্ব ছিল। তারা সে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।
প্রথম সত্য হলো এই যে, স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কোন ধরনের সমাজ চাই, সেটা তারা মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেননি। অনেকে কেবল স্বাধীনতার কথাই ভেবেছেন, মুক্তির স্বপ্নকে উপেক্ষা করে। সম্পদের সামাজিক মালিকানার বিষয়টি তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। কারো কারো কাছে গ্রহণযোগ্যও মনে হয়নি। অগ্রসর চিন্তার বুদ্ধিজীবীদের একাংশ শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। ওদিকে রাষ্ট্রে বুর্জোয়া ধরনের সংসদীয় গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা পায়নি। স্বাধীনতা বুদ্ধিজীবীদের কারো কারো জন্য অপ্রত্যাশিত সুযোগ এনেছে দিয়েছে; যা তারা গ্রহণ করে লোভী ও সুবিধাবাদী হয়ে পড়েছেন। রাষ্ট্র মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে উৎসাহিত তো করেই না, উল্টো ভীতির একটি সংস্কৃতিই গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্রের যারা শাসক হয়েছেন তারা পরমতসহিষ্ণুতা দেখাননি। চিন্তার স্বাধীনতা দিতে চাননি। আনুগত্য দাবি করেছেন। সৃষ্টিশীলতা পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। মুনাফালিপ্সা ও ভোগের স্পৃহা সমস্ত কিছুকে গ্রাস করে ফেলতে চেয়েছে। টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার সংস্কৃতির চর্চায় সামাজিকতার জায়গাতে ব্যক্তিগত উপভোগকে প্রধান করে তুলেছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে তিন ধারার বিস্তারও সমাজ ও সংস্কৃতি উভয়কেই অত্যন্ত ক্ষতিকর রূপে বিভক্ত করেছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেবল টাকাই আসেনি, মৌলবাদের চর্চায় উৎসাহও এসেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়নি; তদবিপরীতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় কওমি মাদ্রাসার সংখ্যাধিক্য ঘটেছে। গণতান্ত্রিক ও সামাজিক সংস্কৃতির চর্চা যাদের করার কথা তারা অনেকেই ঝুঁকে পড়েছেন প্রচার-প্রতিষ্ঠার অভিমুখে। কেউ কেউ আবার সেবকে পরিণত হয়েছেন ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের। পাড়ায়-মহল্লায় সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। এমনকি খেলাধুলার জায়গাও প্রায় নেই। অপরদিকে ওয়াজের নামে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার প্রচারকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। হাস্যকৌতুক বেশ দুর্লভ হয়ে পড়েছে।
অর্জিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা; বিশ্বপরিসরে আত্মপরিচয়ে প্রতিষ্ঠার সুযোগ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষয়িক উন্নতি। ব্যর্থতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে যাওয়া। আমরা আগে ভাবতাম যে আদি সংবিধানে যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির উল্লেখ ছিল তাদের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংজ্ঞাটি রয়েছে; পরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে দিয়েছে যে, সেখানেও অস্পষ্টতা ছিল এবং স্পষ্ট করে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে একটি সামাজিক বিপ্লবের চেতনা, যে বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে সম্পদের ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা। ওই চেতনা থেকে তো আমরা অবশ্যই সরে গেছি। এমনকি আদি রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোও এখন আর কার্যকর নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে মানবিক করে তোলার জন্য তাই সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন প্রধান হয়ে পড়েছে। রাজা-প্রজার পুরনো সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে প্রত্যেকের জন্য সমান অধিকার ও সুযোগের ব্যবস্থা করার স্বপ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধের চালিকা শক্তি। সামাজিক বিপ্লবের ওই লক্ষ্য থেকে আমরা ক্রমাগত সরে এসেছি। বামপন্থিদের প্রধান দুর্বলতা সৃষ্টিশীল জ্ঞানচর্চার অভাব। কেবল যে তত্ত্বগত জ্ঞানের অভাব ঘটেছে তা নয়, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে জ্ঞান আসে অভাব ঘটেছে সেটিরও। পূর্ববঙ্গ যে পাকিস্তানি শাসকদের উপনিবেশে পরিণত হচ্ছিল এবং সে জন্য যে রাষ্ট্রশক্তি দখল করে রাষ্ট্রকে ভেঙে সেখানে একটি জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক এই জ্ঞান লাভে তাদের বিলম্ব ঘটেছে।
জাতিসমস্যাকেও সঠিকভাবে মোকাবিলা তারা করতে পারেননি। উপমহাদেশ ছিল বহুজাতির একটি দেশ, দ্বিজাতিত্ত্ব ভারতবর্ষকে দুই জাতির দেশ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। পাকিস্তানও ছিল একটি নয় পাঁচটি জাতির একটি অবাস্তব, আমলাশাসিত রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের শাসন থেকে মানুষকে মুক্ত করার দায়িত্ব ছিল দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের। তারা সে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে তারা অবশ্যই ছিলেন, কিন্তু নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের হাতে। এবং ওই জাতীয়তাবাদীদের প্রধান শত্রæ ছিল বামপন্থিরাই- ব্রিটিশ আমলে যেমন, পাকিস্তান আমলেও তেমনি। কারণ বামপন্থিরা সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে চায়, আর বুর্জোয়ারা চায় সমাজকাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের দখলে নিতে। বামপন্থিদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কোনো সীমা মানা হয়নি। বাংলাদেশ আমলেও জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের শাসনের অবসান ঘটেনি। বুর্জোয়াদের শাসন বামপন্থিদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। বামপন্থিদের রাজনীতি বুর্জোয়াদের রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের হওয়া দরকার ছিল। সেটা হয়নি। বিশেষ রকমের বিচ্যুতি ঘটেছে নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহের ব্যাপারে। ব্রিটিশ শাসকরা জাতীয়তাবাদীদের জন্য নির্বাচনের ছাড় দিয়ে ফাঁদ পেতেছিল। ওই ফাঁদে পড়ে জাতীয়তাবাদীরা একদিকে আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে নির্বাচনে উৎসাহী হয়েছে, অপরদিকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে; যে বিভাজনের পরিণতিটা দাঁড়িয়েছে দেশভাগ।
দেশভাগের ফলে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বামপন্থিরা। তারা আবার নির্বাচনমনস্কও হয়ে পড়েছেন। এই নির্বাচনমনস্কতা পাকিস্তান আমলেও তাদের মধ্যে ছিল। দেশি-বিদেশি শাসক ও তাদের সমর্থকরা সংস্কৃতিতে ভাববাদিতার যে পরিমণ্ডল তৈরি করে রেখেছিল, বস্তুবাদীদের পক্ষে সেটা ছিন্ন করা ছিল কষ্টসাধ্য। সর্বোপরি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বামপন্থি মহলে যে সংশোধনবাদী প্রবণতা দেখা দেয়, এবং পরবর্তী চীন-রাশিয়া বিরোধ যে বিভাজনের সৃষ্টি করে, সে দুটি ঘটনা ছিল অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটাও তো সত্য যে, বুর্জোয়াদের পক্ষে ‘জাতীয়’ শত্রæকে চিহ্নিত করাটা ছিল সহজ, কারণ তারা বিদেশি; কিন্তু বামপন্থিদের পক্ষে শ্রেণিশত্রæকে চিহ্নিত করাটা ছিল কষ্টসাধ্য, কারণ ওই শত্রæরা স্বদেশি এবং অনেক ক্ষেত্রে ‘আপনজন’।
গণতান্ত্রিক আমল বলতে যা বোঝায় সত্যিকার অর্থে তো সেটা পাওয়াই যায়নি। বাংলাদেশের শাসকরা অত্যন্ত অসহিষ্ণু। তারা লোভ দেখান এবং ভয় দেখান। বুদ্ধিজীবীরা কেউ পড়েন লোভে, অনেকেই থাকেন ভয়ে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ভয়ের একটি সংস্কৃতিই বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। আরেকটি বাস্তবতা হলো এই যে, বুদ্ধিজীবীরা সংগঠিত নন। তদুপরি তারা আবার দলীয়ভাবে বিভক্ত। স্বাভাবিকভাবেই সরকারপন্থি হওয়ার দিকেই ঝোঁকটা থাকে অধিক। দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন দুর্বল; সে কারণেও সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানটা সবল হয় না। তদুপরি মিডিয়া বিরোধীপক্ষের সংবাদ প্রকাশে উৎসাহ প্রকাশ করে না; ফলে সরকারবিরোধী অবস্থান নিলেও সেটা তেমন প্রচার পায় না। রাজনীতিতে, সমাজ জীবনে নিশ্চয় সুবিধাবাদ ছিল ও আছে, পাশাপাশি ভয়ও কাজ করছে।
আমাদের রাজনৈতিক সংকটে বিদেশিদের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ আমরা দেখে থাকি। বিষয়টি লজ্জাকর বটে। অনেক কষ্টে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি; রাষ্ট্রীয় সব সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সেটা ঘটছে না। কারণ রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণি দেশের মানুষের সমর্থনের ওপর ভরসা করে না, তারা বিদেশিদের সমর্থন চায়। শাসকরা পরস্পরের মিত্র নন, কিন্তু আদর্শগতভাবে তাদের মধ্যে নিকটবর্তিতা রয়েছে। তারা সবাই পুঁজিবাদী এবং আমাদের দেশের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা বিশ্ব পুঁজিবাদী বন্দোবস্তেরই অংশ। অন্যদিকে পুঁজিবাদীরা সাম্রাজ্যবাদীও, তারা চায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে। নির্বাচন এলে সরকার পরিবর্তনের একটি সম্ভাবনা দেখা দেয়, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরা চায় তাদের পছন্দের অংশ ক্ষমতায় আসুক; তারা তাই তৎপর হয়ে ওঠে। ঘটনাটা দ্বিপক্ষীয়, দেশীয়রা সাহায্য চায়, বিদেশিরাও প্রস্তুত থাকে সাহায্য দিতে। সামাজিক মালিকানার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে, কিছুটা সফলতাও এসেছিল; কিন্তু ব্যবস্থাটা টেকেনি। প্রধান কারণ পুঁজিবাদের চাতুর্য, প্রচারদক্ষতা ও ক্ষমতা। মানুষ কিন্তু সমাজতন্ত্রী হয়ে জন্মায় না; জন্মায় সে পুঁজিবাদী প্রবণতা নিয়েই; সমাজতন্ত্রী হতে হলে তাকে কষ্ট করতে হয়। সে কারণে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই যে পুঁজিবাদী প্রবণতা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল তা নয়। সেটা ছিল। এবং ওই ছিদ্রপথেই প্রবেশ করেছে পার্টির আমলাতন্ত্র। পার্টির আমলাতন্ত্র সাধারণ আমলাতন্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী। এই আমলাতন্ত্র সমষ্টিচেতনাকে লালন করেনি; উল্টো দমন করেছে। ওদিকে পুঁজিবাদ তার চাতুর্য ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছে। মেহনতিদের ছাড় দিয়েছে, বামপন্থিদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে এবং ভোগবাদিতা প্রচার করেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন এটাও প্রমাণ করল যে পুঁজিবাদের মতোই, সমাজতন্ত্রকেও বিশ্বজনীন করা চাই। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের কিন্তু ব্যক্তি মালিকানার অগ্রগামিতারও ইতিহাস। পুঁজিবাদ হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাবাদী ওই সভ্যতার উন্নতির শেষ প্রান্ত। পুঁজিবাদ যা দেয়ার তা ইতোমধ্যেই দিয়ে ফেলেছে। এখন সে যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। তার দানে ও শোষণে পৃথিবী এখন মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর বসবাসের জন্য প্রায় অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। সভ্যতা এখন হয় ব্যক্তিমালিকানার পথ ধরেই এগোবে এবং খাদে গড়িয়ে পড়বে; নয়তো সামাজিক মালিকানার দিকে ঘুরে গিয়ে ভিন্ন ধরনের উন্নতির নতুন এক সভ্যতার সূচনা ঘটাবে। কোনটি ঘটতে যাচ্ছে, এই প্রশ্নটা আজ সারা বিশ্বের। দেশের জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীরা সংগঠিত নন। তারা ভয় ও লোভের দ্বারা আক্রান্ত। তদুপরি সর্বশক্তিমান প্রচারমাধ্যম যুদ্ধবাজ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের কর্তৃত্বাধীন।
তরুণরা কিন্তু সব সময়েই দুঃসাহসী। সাহস হারালে তাদের সঞ্চয় বলে আর কিছু থাকে না। হতাশা দেখা দেয়। বাংলাদেশে তেমনটাই দেখা যাচ্ছে। একদা যে তরুণরা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, আজ তারা অনেকেই হতাশাগ্রস্ত। কেউ কেউ মাদকাসক্ত। অপরাধীদের কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। ব্যর্থতাটা মূলত সমাজ-পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক শক্তির। তারা তরুণদের সমাজ-পরিবর্তনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণিকে ব্যর্থ বলা যাবে না। তাদের পক্ষে তরুণদের বিপথগামী ও রাজনীতিবিরোধী করে তোলাটাই স্বাভাবিক। তারা চায় না যে তরুণরা বিদ্রোহ করুক। তরুণের সাহসকে তারা ভয় পায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ছাত্রসংসদের নির্বাচন হয় না, সেটা একটা প্রমাণ তারুণ্যের প্রতি শাসক শ্রেণির অবিশ্বাসের। আমরা চারপাশে দেখতে পাই সাধারণ মানুষ আছেন, বিবেকবান মানুষেরও অভাব নেই, তারুণরাও রয়েছে। এরা রাজনীতিকদের ওপর আস্থা হারিয়েছেন ঠিকই; কিন্তু নিজেদের ওপর আস্থা হারাননি। এরা শ্রম দেন এবং স্বপ্ন দেখেন। এদের শ্রম ও স্বপ্নই পরিবর্তনের কারণ হয়ে থাকে। ভরসা করি এরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। কেবল আমাদের দেশে নয়, সব দেশে; এবং সভ্যতাকে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত করবেন। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে না, এবং বাঁচার জন্যই নতুন পৃথিবী গড়বার স্বপ্নটা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।