সিলেট৭১নিউজ ডেস্ক:: ‘সকাল ১১টা। একটা ফোন কল। রিসিভ করার পরই বললেন, ‘আমি মরক্কো থেকে বলছি। জানতে চাইলাম ‘ঘটনা কি?’ জবাব দিলেন, ‘বিস্তারিত বলতে পারবো না। অনেক কষ্টে এক ‘কালার’ (আফ্রিকান) কাছ থেকে মোবাইল নিছি, বেশি কথা বলছি, জানতে পারলে মারবে।’ মোবাইলটা কার জানতে চাইলে বলেন, ২০ ইউরো দিলে মাঝে-মধ্যে এক মিনিট কথা বলতে দেয়। মোবাইলটা তাদেরই দায়িত্বে থাকা এক আফ্রিকানের। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আতঙ্ক নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন, রাজধানীর খিলক্ষেতের বরুয়ার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম। জাহিদুল তাকে উদ্ধারের আকুতি জানান। কীভাবে সেখানে গেলেন- জানতে চাইলে ৩২ বছরের এই যুবক বলেন, দু্বাই থেকে আলজেরিয়া হয়ে বর্তমানে তার ঠাঁই হয়েছে মরক্কোতে মানব পাচারকারীদের একটি বন্দিশালায়। প্রত্যেক দেশেই আলাদা আলাদা বন্দিশালায় তার ওপর চলেছে অমানবিক নির্যাতন।
এরপর আরও কিছু জানতে চাইলে আতঙ্কিত কণ্ঠে জাহিদুল বলেন, ‘ভাই আমি আর কিছুই বলতে পারবো না। আর কথা বললেই আমাকে মারবে।’ এ সময় ফোনের অপর প্রান্তে অস্পষ্ট গর্জন শোনা যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ফোনের সংযোগ।
বছর তিনেক আগে জাহিদুল ইসলামকে ইতালির উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মানব পাচারকারীদের একটি সিন্ডিকেট। সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে সরল বিশ্বাসে সিন্ডকেটের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বিপুল অঙ্কের টাকা। কিন্তু দেশের গণ্ডি পার হওয়ার পর সে বিশ্বাস অভিশাপে পরিণত হয়। তাকে দুবাই, আলজেরিয়া হয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মরক্কোতে। বর্তমানে সেখানে তাদের একটি অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা হয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছেন আরও ৭ বাংলাদেশি। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার হাজীগঞ্জের মাহমুদ আলী, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের কাজীরহাট থানার চর সন্তোষপুর গ্রামের সুলাইমান মুন্সীর ছেলে নাঈম হোসাইন, মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার বাসিন্দা সাজ্জাদ খান এবং একই উপজেলার আটিপাড়া গ্রামের আরিফ হাওলাদার তার সঙ্গে একই ভাগ্যবরণ করেছেন।
বন্দিদশায় তাদের ওপর চলছে অমানসিক নির্যাতন। এদিকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে নিয়মিত টাকা দিতে হচ্ছে সিন্ডিকেটের। তারপরও মুক্তি মিলছে না। চাহিদা মোতাবেক টাকা না দিলেই নেমে আসছে নির্যাতনের খড়গ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানব পাচারকারীদের শক্তিশালী আন্তর্জাতিক এই সিন্ডিকেটটি নিয়ন্ত্রণ করেন মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার খসেরহাট ইউনিয়নের মৌলভীকান্দি গ্রামের ৪ ভাই আল আমিন সরদার, মুনির সরদার, রুবেল সরদার ও হান্নান সরদার। এদের মধ্যে আল আমিন সরদার থাকেন বাংলাদেশে, হান্নান সরদার ও রুবেল সরদার থাকেন স্পেনে আর মুনির সরদারের অবস্থান মরক্কোতে। জাহিদুল ও জিম্মি অন্যরা তার জিম্মাতেই রয়েছেন।
জানা যায়, তিন বছর আগে স্পেনে অবস্থানরত জাহিদুল ইসলামের চাচাতো ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচয় হয় সরদার গংদের সঙ্গে। উন্নত জীবন আর রুটি-রুজির আশায় আল আমিন সরদারের হাতে তুলে দেন ১৩ লাখ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাহিদুলের সঙ্গে আটক অন্যরাও একই অঙ্কের টাকা দিয়েছেন। কিন্তু তাদের কেউ-ই ইতালি পৌঁছতে পারেননি। কয়েক দেশ ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বন্দিশালার টর্চার সেলে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রথমে দুবাই। সেখানে তার সঙ্গে ছিলেন আরও ২০-২৫ বাংলাদেশি। দুবাই থেকে তাদের কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হয় আলজেরিয়া। পরে আলজেরিয়া থেকে তাদের ৭ জনকে নেয়া হয় মরক্কোতে।
দেশটির অজ্ঞাত স্থানে একটি ৭ তলা বাড়ির ছাদে একটা কক্ষে রাখা হয়। মূলত তখন থেকেই জিম্মিদশা শুরু তাদের। সেখানে তাদের বাইরে বের হওয়া নিষেধ। কড়া পাহারায় রয়েছে সশস্ত্র আফ্রিকান। কেড়ে নেয়া হয়েছে মোবাইল ফোন। একবেলা খাবার দেয় তো, দুই বেলা দেয় না। নেই গোসলের ব্যবস্থাও। এই অবস্থায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে তাদের। শুধু তাই-ই নয়, মাঝে মাঝে দেশ থেকে টাকা পাঠানোর জন্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে। আর এই টাকা দিতে হয় দেশে থাকা আল আমিন সরদারের কাছে। এরই মধ্যে জাহিদুল কয়েকবার পালিয়েছেন বন্দিশালা থেকে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
মানব পাচারের ওই আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট আবারো তাকে ধরে নিয়ে জিম্মি করে বন্দিশালায়। মরক্কোর এই বন্দিশালাটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন- মাদারীপুরের ৪ ভাইয়ের এক ভাই মুনির সরদার। তিনিই হোয়াটস্অ্যাপে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। টাকা দাবি করেন। এভাবেই চলছে। যেনো শেষ নেই এই দুর্দশার। টাকা পাঠাতে হয় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এ/সি নং ১৬৪১৫১২৫৭৭৪৩ এবং ইসলামী ব্যাংকের এ/সি নং ৪৪৪৬৬-এ। এছাড়া আরও কয়েকটি অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠান জিম্মি থাকা ব্যক্তিদের স্বজনরা। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতারিত জাহিদুলের মা অসুস্থ। তবে তিনি জানেন না তার ছেলে কোথায় আছে, কেমন আছে। ‘চাকরি হয়নি এখনো’ এমন কথা বলেই টাকা পাঠাতে বলেন জাহিদুল।
জাহিদুলের ভাষ্য, অসুস্থ মা তার প্রকৃত অবস্থার কথা শুনলে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। জাহিদুলের এক স্বজন জানিয়েছেন- +২১২৭০৫১৯৪০৩৮ এই হোয়াটস্অ্যাপ নম্বর থেকে ফোন করা হয়। কিন্তু পরবর্তী কেউ ফোন দিলে আর কল ঢোকে না। জাহিদুলের এই স্বজনের আকুতি জিম্মির পরিবারগুলো সিন্ডিকেটটির টাকা দিতে দিতে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখন আর দেয়ার কিছুই নেই। এই অবস্থায় তাদের জীবন নিয়ে শঙ্কিত। সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে তাদের উদ্ধারের আকুতি জানিয়েছেন এই স্বজন। এদিকে মানব পাচারকারীদের ব্যবহৃত নম্বরে একাধিকবার কল করে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
সিলেট৭১নিউজ/টিআর/সুত্র: সিলেট ভিউ/০৩/০৯/২২