সিলেট৭১নিউজ ডেস্ক;: অবশেষে খুশির সংবাদ পাচ্ছেন পাথর ব্যবসায়ীরা। পাথর কোয়ারি, পাথর উত্তোলন, খাস আদায় এবং জব্দ পাথর উন্মুক্ত নিলামের বিষয়ে দায়ের করা মামালাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সরকার।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, লালমনিরহাট জেলা এবং সিলেট বিভাগের সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসককে (ডিসি) গত ২ জুন চিঠি পাঠানো হয়েছে।
পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে গত ৩১ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভার কার্যপত্রে বলা হয়, পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট বিরূপ প্রভাব ও উত্তোলন বন্ধের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিবের নেতৃত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিবের নেতৃত্বে একটি উপ-কমিটি ২০২০ সালের ২৯ ও ৩০ আগস্ট সিলেট জেলার পাথর কোয়ারিগুলো পরিদর্শন করেন।
পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন) গঠিত অপর একটি উপ-কমিটি ২০২১ সালের ৭ ও ৮ জানুয়ারি রংপুর বিভাগের পঞ্চগড় এবং লালমনিরহাট জেলার পাথর কোয়ারিগুলো পরিদর্শন করেন। গত বছর ১৫ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ১৩টি সুপারিশসহ বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের কাছে জমা দেন।
এই দুই কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে গত ৩১ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সিলেট ও লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য, নৌ-পরিবহন, বেসাময়িক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো এবং বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, পরিবেশগত ক্ষতি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাহিদা ও জোগান, আমদানি সম্ভাব্যতা এবং আর্থিক বিষয়গুলো বিবেচনায় কৃষি জমি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।
এছাড়া জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বিদ্যমান গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারিগুলো পুনরায় ইজারা প্রদান করা যাবে কি না তা যাচাই করার লক্ষ্যে জিওগ্রাফিক্যাল সার্ভে এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য, বেসাময়িক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতর, রংপুর ও সিলেট বিভাগীয় কমিশনার এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
গঠিত এ কমিটি গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারিগুলোর মজুদ পাথরের পরিমাণ, উত্তোলনযোগ্য পাথরের পরিমাণ, উত্তোলনের সময়কাল, পাথর কোয়ারির এলাকার পরিবেশ, নদীর নাব্যতা সঙ্কট বিবেচনায় মানব স্বাস্থ্য, কৃষি, ইকো-সিস্টেম, মৎস্য ও জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং পযটন শিল্পের বিকাশ বিবেচনা করে পাথর কোয়ারির তালিকা হালনাগাদ করবে। এই কমিটিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আরো সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে। তা আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এছাড়া পাথর ভাঙার জন্য সিলেট জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ, গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এবং সুনামগঞ্জ জেলার তাহেরপুর উপজেলায় একটি এবং পঞ্চগড় জেলার বাংলাবান্ধা ও লালমনিরহাট জেলার বুড়িমারি এলাকায় দুইটি ক্রাশার জোন শিল্প মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে স্থাপনের উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে স্টোন ক্রাশিং মেশিন স্থাপন নীতিমালা-২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) এর প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন আনা যেতে পারে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাথর কোয়ারির সাথে সম্পৃক্ত মহিলা শ্রমিকদের মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের আয়বর্ধক প্রকল্পের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রম আইন ২০১৬-এর আওতায় পাথর শ্রমিকদের জন্য নতুন বিধিমালা এবং নীতিমালা প্রণয়নের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
পরিবেশ অধিদফতর প্রচলিত বিধিবিধানের আলোকে পাথর কোয়ারি জন্য পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ)-এর একটি জেনেরিক টিওআর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দিতে পারবে এবং ইআইএ সম্পাদন সংক্রান্ত আবেদনটি অতিদ্রুত নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে, সিলেটের একাধিক পাথর কোয়ারি থেকে পাথর আহরণ, উত্তোলন বন্ধ করতে বছরখানেক আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশের আলোকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় পাথর উত্তোলন। এর আগে ২০১৮ সাল থেকে বিভিন্ন কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি ২০১৪ সালে উচ্চ আদালত সিলেটের সব পাথর কোয়ারিতে যন্ত্রের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। পাথর কোয়ারিতে অচলাবস্থার মধ্যে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশ ৬ মাসের জন্য স্থগিত ও সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু উচ্চ আদালতের সেই আদেশ-নির্দেশনা স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে তা স্থগিত করা হয়। ফলে আবার দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে পাথর কোয়ারি চালু প্রক্রিয়া। যদিও রিট আবেদনকারীরা সুপ্রিম কোর্টে আবার আপিল করেছেন।
গত বছর ২ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে একটি চিঠি যায় সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কাছে। চিঠিতে কোয়ারি ইজারা দেওয়াসহ ছয় দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- পাথর উত্তোলনে অনুমতি দেওয়া হলে উত্তোলনের ফলে তৈরি হওয়া গর্তগুলো ভরাট করা, ইতঃপূর্বে পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট গর্ত ভরাট ও বনায়ন করা, হাজার হাজার পাথর শ্রমিকের বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে শিল্প-কারখানা স্থাপন ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ, জাফলং ও ভোলাগঞ্জে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া ও নিয়মিত টাস্কফোর্সের অভিযান অব্যাহত রাখা।
আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার কার্যপত্রে বলা হয়, সিলেট জেলা প্রশাসক জানান সুপারিশের বিষয়টি তিনি অবগত হয়েছেন। তবে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ইজারা সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা এখনও তিনি পাননি। বছরের পর বছর ধরে সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীদের পক্ষে রিট আবেদন করা হয়।
অন্যদিকে, সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার লোভা নদীর দু’পাড়ে জব্দ প্রায় ১ কোটি ঘনফুট পাথর আদালতের রায়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলে তা নিলামে বিক্রি করতে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং সিলেট জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
সিলেট৭১নিউজ/ইফতি রহমান