সিলেট৭১নিউজ ডেস্ক;: স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। এই সেতুর মাধ্যমে শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের দুর্ভোগেরই অবসান হবে না; ওই অঞ্চল তথা দেশে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এটি এক মাইলফলক হবে। তাই সেতুর ওপর দিয়ে কবে গড়াবে গাড়ির চাকা, সেই দিনক্ষণ গণনা চলছে। তবে অপেক্ষার পালা শেষ। এবার সেতুর ওপর দিয়ে পদ্মা পাড়ি দেয়ার পালা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময় দিলেই সেতু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। এরই মধ্যে সেতুর সড়কের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। সেতুর রোড মার্কিং ও সংকেত, স্টিলের রেলিং বসানো, সেতুর নামফলক, ম্যুরাল স্থাপনসহ ভায়াডাক্টের সামান্য কাজ যা বাকি আছে তা ১৫ দিনের মধ্যেই শেষ হবে। উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতার কোনো শিডিউল সেতু মন্ত্রণালয় বা প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা না জানলেও জুনের শেষ দিকে উদ্বোধনের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। সেতুর উভয় প্রান্তের প্রকল্প এলাকার চারপাশে ১ কিলোমিটারের মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। চার স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেতু বিভাগ, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ), স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উভয় প্রান্ত পরিদর্শনের পর টহল ও নজরদারি জোরদার করেছেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের ভোরের কাগজকে বলেন, সেতুর ৯৮ শতাংশের বেশি কাজ শেষ। সব ধরনের যানবাহন সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলের জন্য সেতু পুরোপুরি প্রস্তুত। রোড মার্কিং ও সংকেত, স্টিলের রেলিং বসানো ও ভায়াডাক্টের সামান্য যে কাজ বাকি আছে, সেগুলো চলছে। সেতুর নামফলক স্থাপন করা হবে। সেতুর মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার দুটি ম্যুরাল স্থাপন করা হবে। ১৫ দিনের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে। সব লাইটপোস্টে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। নদী শাসনের কাজ একবারেই শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মাওয়া অংশে নদী শাসনের শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। জাজিরা প্রান্তের নদী শাসন পুরোপুরি শেষ।
মো. আব্দুল কাদের আরও বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনক্ষণ এখনো নির্ধারণ হয়নি, আমরা কিছুই জানি না। কোথায় কী অনুষ্ঠান হবে, আমরা তাও জানি না। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে আমরা পদ্মা সেতুর দুই প্রান্ত পুরোপুরি প্রস্তুত রেখেছি। গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয় থেকে সেতু এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশনা আসে। প্রকল্প এলাকায় প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা এলাকা পরির্দশন করছেন।
জুনেই উদ্বোধন : তারিখ এখনো ঠিক না হলেও তোড়জোড় থেকে একরকম ধরে নেয়া যায় যে জুন মাসেই পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচিত হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর আগে বলেছেন, জুনেই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করা হবে। গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামও একই ইঙ্গিত দিয়েছেন। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে তিনি বলেছেন, জুনের শেষের দিকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হবে, আমরা প্রস্তুত। তবে তারিখ এখনো নির্ধারণ হয়নি। আমার মনে হচ্ছে ৪-৫ দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি স্পষ্ট করবেন।
এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জুনের শেষ সপ্তাহে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হবে এটা অনেকটাই নিশ্চিত। এজন্য ২৩ অথবা ২৫ জুন মাথায় রেখেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সেতু বিভাগ ১৮টি উপকমিটিও গঠন করেছে। কমিটিগুলো কাজ করছে। তবে চূড়ান্ত তারিখ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়ার পর সেই অনুযায়ী অনুমোদনের জন্য সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র ছাপানো, মঞ্চ ও প্যান্ডেল তৈরি এবং অন্যান্য প্রস্তুতিমূলক কাজ দ্রুতই শেষ করা হবে। জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা উপস্থিত থাকবেন।
গত বৃহস্পতিবার সেতু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেতুর মাওয়া প্রান্তের ভায়াডাক্টে রোড মার্কিংয়ের কাজ চলছে। জাজিরা প্রান্তে রোড মার্কিংয়ের কাজ আগেই শেষ হয়েছে। সেতুতে রোড সংকেত সাইন লাগানোর কাজ চলছে। গত মাসে ৪১৫টি লাইটপোস্ট বসানো হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতুতে ৩২৮টি। লাইনে মিটার বসানো বাকি আছে। চলতি মাসের মধ্যে এই কাজও শেষ হবে। লাইটপোস্টে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার পর পরীক্ষা করেও দেখা হচ্ছে। চলতি মাসের শেষ দিকে পুরো সেতু আলোকিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পুরো সেতুতে আলো জ¦লে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাতের বেলায় সেতু পদ্মার বুকে আলো ছড়াবে। শুক্রবার থেকেই সেতুর দুই পাশের সীমানা দেয়ালের ওপর স্টিলের রেলিং বসানো শুরু হবে। সব রেলিং প্রস্তুত রয়েছে। শুক্রবার থেকে রেলিংগুলো তুলে নিয়ে দেয়ালের ওপর বসানো শুরু হবে। ১০ দিনের মধ্যে রেলিং বসানোর কাজ শেষ হবে বলে জানান প্রকৌশলীরা।
মাওয়া প্রান্তে নদী শাসনের শেষ মুহূর্তের কাজ বেশ জোরেশোরেই চলছে। সেতুর ডান পাশের নদীতীরে নদী শাসনের কাজ চলতে থাকায় এখন আর দর্শনার্থীদের ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। কিছু দিন আগেও সেখানে বিকালে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় হতো। পর্যটক বহনকারী নৌকাগুলো এখন শিমুলিয়া প্রান্তে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখান থেকেই পযটকরা সেতুর অনেক দূর থেকে পদ্মায় ভ্রমণ করেন। কয়েক মাস আগেই জাজিরা প্রান্তে নদী শাসনের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। এতে ওই এলাকা আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজা থেকে সেতুতে ওঠার সড়কের দুই পাশে নিরাপত্তা ফেন্সিংয়ের কাজ চলতে দেখা গেছে। লোহার খুঁটি বসিয়ে মোটা নেট দিয়ে ঘিরে দেয়া হচ্ছে। টোল প্লাজা থেকে সিসি ক্যামেরা বসানো হবে।
প্রস্তুত দুই প্রান্ত : এখনো দিনক্ষণ নির্ধারণ না হলেও জুনের শেষ সপ্তাহে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সম্ভাবনাই বেশি। সেজন্য মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা উভয় প্রান্তই প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আনুষ্ঠানিকতার কোনো শিডিউল আমরা এখনো জানি না। তারপরও আমরা সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। প্রধানমন্ত্রী মাওয়া প্রান্ত থেকে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এরপর তিনি জাজিরা প্রান্তে গিয়ে টোল প্লাজায় আরেক দফায় উদ্বোধনী কাজে অংশ নেবেন। তাই উভয় প্রান্তেই সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। এরপর মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়িতে একটি জনসভায় যোগদানের সম্ভাবনাও রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।
সেতু এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার : প্রধানমন্ত্রীর কোনো সফরের আগে ধাপে ধাপে যেভাবে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়, তা মাওয়া ও জাজিরা এলাকায় শুরু হয়েছে। এই ব্যবস্থাপনা দেখে বোঝা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিগগিরই মাওয়া আসছেন। গত সপ্তাহ থেকে পদ্মা সেতুর উভয় পাড়ের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেতু বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উভয় প্রান্ত একত্রে পরিদর্শন করেছেন। এছাড়া চার স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসএসএফ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সেতু বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন কাজ শুরু করেছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সমন্বয় সভাও করেছেন বলে জানা গেছে। তারা নিñিদ্র নিরাপত্তার জন্য দফায় দফায় পরিদর্শন করছেন। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সেনাবাহিনী-পুলিশের টহল চলছে। মাওয়া চৌরাস্তা এলাকার শিমুলিয়া ঘাটে যাওয়া-আসার রাস্তাটুকু ছাড়া প্রকল্প এলাকার সব পথেই নজরদারি বেড়েছে। সেতুতে ওঠার সড়কের উভয় দিকে নিরাপত্তা ফেন্সিংয়ের কাজ চলছে।
রেল সংযোগ : পদ্মা সেতু প্রকল্পের রেলওয়ে অংশের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকৌশলীরা জানান, সেতুর সাড়ে ৩৯ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার রেল সংযোগের কাজ ৫৫ দশমিক ২৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। রেলের কাজ শেষ হতে আরো ছয় মাস লাগবে। চলতি বছরে ডিসেম্বরের আগে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা রেললাইন চালুর কোনো সম্ভাবনা নেই। সেতুর রেলওয়ে অংশের কাজ ভালোভাবে শুরু হলেও সেতুর জাজিরা প্রান্তে পিলার জটিলতায় নকশা বদলাতে হয়। এ সময় বেশ কিছুদিন রেলওয়ের কাজ বন্ধ ছিল। সব সমস্যা কাটিয়ে এখন সেতুর নিচতলায় রেলওয়ের কাজ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। সেতুর মাওয়া ও জাজিরা দুই প্রান্তের রেললিংক প্রকল্পে রেলস্টেশন নির্মাণ, ভায়াডাক্ট, রেলসেতু ও রেললাইনের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। এক্সিলেটর সিঁড়ি ব্যবহার করে যাত্রীদের প্লাটফর্মে ওঠার ব্যবস্থা থাকবে।
প্রকৌশলীরা আরো জানান, এদিকে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত রেললাইন বসানোর কাজ এগিয়ে চলছে। এই রেললাইনের ওপর কোনো পাথর থাকবে না। সেতুর ওপরের অংশের লাইনেও পাথর থাকবে না। পাথরবিহীন রেললাইনের ওপর দিয়েই ঢাকা থেকে ট্রেন চলাচল করবে। রাজধানীর সঙ্গে রেল যোগাযোগ দ্রুত সংযুক্ত করতে তিন শিফটে কাজ চলছে। কমলাপুর থেকে শ্যামপুর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার অংশে ভূমি অধিগ্রহণে প্রথম দিকে সমস্যা হলেও এখন আর নেই। ঢাকা থেকে মাওয়া অংশের পলাশপুর এলাকায় শুরু হয়েছে পাথরবিহীন রেললাইন বসানোর কাজ। ক্রেনের সাহায্যে ভায়াডাক্টের ওপরে লোহার রেললাইন তোলা হচ্ছে। এরপর লোহার গেজবাফল, এলাস্টিক ক্লিপ, ফাইবারের ইন্সুলেটার ও ফাসনার কানেক্টর দিয়ে স্লিপারের সঙ্গে আটকে দেয়া হচ্ছে। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিএসি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে রেল প্রকল্পের কাজ এগোচ্ছে।
উল্লেখ্য, সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সেতু নির্মাণে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বাড়বে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
সিলেট৭১নিউজ/ইফতি রহমান