সিলেট৭১নিউজ ডেস্ক;: সিলেটে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে ১০৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৯টি। এতে সিলেট মহানগরীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইলের নেটওয়ার্ক সমস্যায় পড়েছেন দুর্গত এলাকার পানিবন্দী কয়েক লাখ মানুষ। রাত হলেই আতঙ্ক ভর করছে তাদের মধ্যে।
এদিকে বুধবার (১৮ মে) সিলেট জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বন্যা শুরু হওয়ার পর এই জেলায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি না পেলেও সিলেটে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অফিস বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আভাস দিয়েছে।
বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকার লোকজনের সঙ্গে বৃহস্পতিবার (১৯ মে) কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণ সুরমা সাব স্টেশন পানিতে ডুবে গেছে। ফলে মঙ্গলবার সকাল থেকেই ওই কেন্দ্রটির গ্রাহকরা বিদ্যুৎ বিভ্রাটে রয়েছেন।
জানা গেছে, নগরীর উত্তর দিকের ঘাসিটুলা, কানিশাইল, তোপখানা, তালতলা এলাকায় বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ওইসব স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।
পল্লী বিদ্যুতের বিয়ানীবাজার এলাকার শেওলা সাবস্টেশনে যে কোনো সময় পানি প্রবেশ করতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ সাবস্টেশনটি বন্ধ হলে সিলেটের জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। তাছাড়া, গ্রামাঞ্চলে পল্লী বিদ্যুতের তারের নিচ দিয়ে সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করতে মাইকিং শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।
দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি ১ নম্বর রোডে অবস্থিত বিদ্যুৎ বিভাগ-৩-এর বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের সাবস্টেশনে পানি প্রবেশ করায় গোটা এলাকা মঙ্গলবার সকাল থেকে বিদ্যুৎহীন রয়েছে। বৃহস্পতিবার পাওয়া শেষ খবর অনুযায়ী সেখানে এখেনো বিদ্যুৎ নেই। ফলে আলমপুর বিভাগীয় অফিস, বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস, ডিআইজি অফিস, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ির লোকজন চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।
ওই সাব-স্টেশনের আওতাধীন টেকনিক্যাল রোড, বরইকান্দি, মোল্লারগাঁও, নিয়ামতপুর, সুনামপুর, স্টেশন রোড, বঙ্গবীর রোড, ঝালোপাড়া রোড, চাঁদনীঘাট রোড, বাস-টার্মিনাল রোড, কদমতলী, মোমিনখলা, শিববাড়ী, চান্দাই, জয়নপুর, ঝালোপাড়া, খোজার-খলা, ভার্থখলা, লাউয়াই, ফিরোজপুর, হুমায়ুন রশীদ চত্বর, চন্ডিপুল, সিলেট রেলওয়ে স্টেশন, বাস-টার্মিনাল, বদিকোণা, মাসুকগঞ্জ বাজারসহ আশেপাশে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় ভুতুরে পরিবেশ বিরাজ করছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় এলাকায় চুরি ডাকাতির আশঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এছাড়া হোটেল ও বাসা-বাড়ির ফ্রিজে থাকা মাছ, মাংস, তরকারি নষ্ট হতে চলেছে বিদ্যুত না থাকার কারণে। দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় খাবার, রান্না ও ওজুর পানি না পেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরেও দু’দিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় লোকজন সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
বন্যার কারণে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে পল্লীবিদ্যুতের ওপর নাখোশ গ্রাহকরা। ভুক্তভোগিরা অভিযোগ করে বলেন, অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। রাত চরম আতঙ্কে কাটছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেট অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদির বলেন, ‘বন্যার কারণে দক্ষিণ সুরমা সাব স্টেশনে পানি প্রবেশ করায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। বিকল্প উপায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।’
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুর রহমান বলেন, ‘সঙ্কটের সময়ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। নগরীর ঘাসিটুলা, কানিশাইল, তোপখানা এলাকায় বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।’
পল্লী বিদ্যুৎ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী দিলীপ চন্দ্র চৌধুরী বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে পল্লী বিদ্যুতের তারের নিচ দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করতে ইতোমধ্যে মাইকিং শুরু হয়েছে। শেওলা সাবস্টেশনে যে কোনো সময় পানি প্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে।’
এদিকে বন্যায় নগরীসহ পুরো জেলায় ব্যাহত হচ্ছে সড়ক যোগাযোগও। বুধবার বিকেলে সিলেটে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় পানি আরো বাড়তে পারে বলে আভাস দেওয়া হয়।
সিলেট সদরসহ সীমান্তবর্তী উপজেলা কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরবর্তীত রয়েছে। গরু-মহিষ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন ওই সব এলাকার খেটে খাওয়া মানুষজন। উপজেলার স্কুলগুলোকে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট জেলায় এ পর্যন্ত ২৭৫টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট নগরীতে খোলা হয়েছে ২২টি আশ্রয় কেন্দ্র। সিলেটে ৭৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজন আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে মোট আশ্রিত লোকের সংখ্যা ৬ হাজার ৪৭৫ জন।
সিলেট জেলার ১০৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৫টি ইউনিয়ন সম্পূর্ণভাবে এবং ৪টি ইউনিয়ন আংশিক প্লাবিত হয়েছে। বন্যা কবলিত হয়েছে প্রায় ১২ লাখ মানুষ। বন্যায় আউশধানের বীজতলা ১ হাজার ৩০১ হেক্টর এবং বোরো ধানের ১ হাজার ৭০৪ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৪ হেক্টর জমির।
এলজিইডি’র ২০১.২২৩ কিলোমিটার রাস্তা এবং ২৮ মিটার কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের ১০টি সড়কের ৫৫.৬০ কিলোমিটার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যার কারণে নৌকাডুবিতে সিলেট সদর ও জৈন্তাপুর উপজেলায় ৩ জন এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলায় পাহাড় ধসে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের উপসহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা বলেন, ‘উজানে এখনো প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটে। এখনো সবকটি নদ নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী বলেন, ‘নগরীতে বন্যা আশ্রয়ণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রিত পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সেবা তারা পাবেন। পুরো বিষয়টি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।’
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘কিছু সরকারি স্থাপনায় পানি উঠলেও সেবা ব্যাহত হচ্ছে না। সব প্রতিষ্ঠানেরই স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত আছে। গ্রামে গ্রামে পৌঁছানো হচ্ছে ত্রাণসামগ্রী।’
সিলেট৭১নিউজ/ইফতি রহমান