আব্দুল কাদের তাপাদার:: পিতাকে হত্যার অপরাধে তার দুই পুত্র এক যুবককে টেনে হিঁচড়ে খলিফা ওমর (রাঃ) এর দরবারে এনে হাজির করলো। তারা বললো, এই ব্যক্তি আমাদের পিতাকে হত্যা করেছে হুজুর, আমরা এর উপযুক্ত বিচার চাই। খলিফা ওমর (রাঃ) ঐ যুবকের কাছে তার বিরুদ্ধে আনা হত্যার অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে যুবক বললো, অতি ক্লান্তি অনুভব করার কারণে আমি একটু খেজুর গাছের নিচে বসে বিশ্রাম করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
উঠে দেখি আমার উট আমার পাশে নেই। খুঁজতে গিয়ে যখন সামনের দিকে আগাই তখন সেটির মৃতদেহ দেখতে পাই যেটিকে উনাদের পিতা বাগানে প্রবেশের অপরাধে পাথরের আঘাত করে হত্যা করেন।এই বিষয়ে যখন আমি তার সাথে কথা বলতে গেলে আমাদের মধ্যে অনেক কথা কাটাকাটি হয় এবং বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে আমি উত্তেজিত হয়ে তাকে পাথর দিয়ে আঘাত করি যার ফলে তিনি মারা যান, যা সম্পূর্ণ ছিল অনাকাঙ্খিত একটি ঘটনা, যার জন্য আমি অনুতপ্ত এবং ক্ষমা প্রার্থী।
বাদীগণ বললেন, কোনো ক্ষমা নয় মাননীয় খলিফা, আমরা এর মৃত্যুদণ্ড চাই।হযরত ওমর (রাঃ) অভিযুক্ত ব্যক্তিটিকে বললেন, উটের বদলে তুমি একটা উট নিলেই তো পারতে! কিন্তু তুমি বৃদ্ধকে হত্যা করেছো; হত্যার বদলে হত্যা। আইনানুযায়ী এখন তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তোমার কোনো শেষ ইচ্ছা থাকলে বলতে পারো। লোকটি বললো, আমার কাছে কিছু আমানত আছে এবং আমি কিছু মানুষের কাছে ঋণী। আমাকে যদি কিছুদিন সময় দিতেন, আমি বাড়ি গিয়ে সেই ঋণ পরিশোধ ও আমানতগুলো ফিরিয়ে দিয়ে আসতে পারতাম! খলিফা ওমর (রাঃ) বললেন, তোমাকে তো আমি একা ছাড়তে পারি না। তুমি যদি তোমার তরফ থেকে কোন জিম্মাদার রেখে যাও তবে কিছু সময়ের জন্য তোমাকে মুক্তি দিতে পারি।
যুবক তখন দুঃখিত হয়ে বললো, এখানে সবাই আমার অপরিচিত। না কেউ আমাকে চেনে আর না আমি কাউকে চিনি। সুতরাং আমার জামিনদার হবার মতো কেউ নেই, হুজুর।তখন রাসূল (সাঃ) এর প্রিয় সাহাবী হযরত আবুজর গিফারী (রাঃ) সবার মধ্য থেকে উঠে বললেন, হুজুর, আপনার যদি অনুমতি থাকে তবে আমি হতে চাই এই যুবকের জামিনদার। তার এই কথায় সভার সবাই আবাক হয়ে যায় কারণ, তিনি ঐ যুবককে চিনতেন না, জানতেনও না কিন্তু তারপরও তিনি জামিনদার হতে রাজি হয়েছেন।
খলিফা বললেন, আগামি জুম্মাবার পর্যন্ত যুবককে মুক্তি দেয়া হোলো। জুম্মার আগে যুবক মদিনায় ফিরে না আসলে তার পরিবর্তে আবুজরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। জামিন পেয়ে নওজোয়ান ছুটলো মাইলের পর মাইল দূরে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আবুজর গেলেন তার বাড়ির দিকে। এদিকে দেখতে দেখতে জুম্মাবার চলে এসেছে নওজোয়ানের কোনো খবর নেই।
হজরত ওমর (রাঃ) রাষ্ট্রীয় পত্রবাহক পাঠিয়ে দিলেন হজরত আবুজর গিফারী (রাঃ) এর কাছে। সেই পত্রে লেখা ছিল, আজ বাদ জুম্মা সেই যুবক যদি ফিরে না আসে তবে আইন মোতাবেক আবুজর গিফারী (রাঃ)’র মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। আবুজর যেন জুম্মার প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে নববীতে সঠিক সময় হাজির হয়।
এই খবর শুনে পুরো মদিনায় থমথমে অবস্থা। একজন নিষ্পাপ সাহাবী আবুজর গিফারী আজ বিনা দোষে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে। জুম্মার পর সবাই মসজিদে নববীর সামনে হাজির। সবার চোখে পানি, জল্লাদ প্রস্তুত। জীবনে কত জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তার হিসাব নেই। কিন্তু আজ কিছুতেই চোখের পানি আটকাতে পারছে না। আবুজরের মতো একজন ভালো সাহাবী আজ বিনা দোষে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছে এটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদানকারী খলিফা ওমর (রাঃ) নিজেও অনাবরত কাঁদছেন। তবুও আইন নিজের গতিতে চলবে।
তখন আবুজর (রাঃ) নিশ্চিন্ত মনে হাসিমুখে এক কোণে দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের জন্য প্রস্তুত। জল্লাদ ধীর গতিতে আবুজর (রাঃ) এর দিকে এগুচ্ছে আর কাঁদছে, জল্লাদের পা যেন আজ সামনে এগুচ্ছে না। কেউ যেন তার পায়ে পাথর বেঁধে রেখেছে। প্রস্তুত আবুজর, তরবারি হাতে প্রস্তুত জল্লাদ। একটি কোপের অপেক্ষা মাত্র। ভয়ে সবাই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। এমনসময় এক সাহাবী জল্লাদকে থামিয়ে বলল, ঐ দেখ মরুভূতে ধুমিলোর ঝড় উঠিয়ে কে যেন আসছে এদিকে। একটু থামো। হতে তো পারে ওটা যুবকের ঘোড়ার ধুলি। একটু দেখে নাও তারপর না হয় আবুজরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর কোরো।
কাছে এলে দেখা গেলো ওটা ঐ যুবকেরই ঘোড়া। লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়ে কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে যুবক বললো, হুজুর বেয়াদবি মাফ করবেন, পথে যদি ঘোড়া পায়ে ব্যাথা না পেতো তাহলে সঠিক সময় এসে পৌঁছাতাম। বাড়িতে আমি একটুও দেরি করিনি। গচ্ছিত আমানত ফেরত ও ঋণ পরিশোধ করে বাবা-মা ও নববঁধূর কাছে সব খুলে বলে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে তাদের চিরবিদায় জানিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। এখন আবুজর (রাঃ) ভাইকে মুক্ত করে দিন। আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পাপ মুক্ত করুন। রোজ হাশরের ময়দানে নিজেকে খুনি হিসেবে আল্লাহর সামনে হাজির করতে চাই না।
চারিদিকে থমথমে অবস্থা, কী হতে চলেছে। যুবকের ফিরে আসাটা যেন হতবাক করে দিয়েছে সবাইকে। খলিফা হজরত ওমর (রাঃ) যুবককে বললেন, তুমি জানো তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে তারপরও কেন ফিরে এলে?
উত্তরে সেই যুবক বললো, আমি ফিরে এসেছি যাতে কেউ বলতে না পারে যে এক মুসলিম আরেক মুসলিমকে সাহায্য করতে এসে নিজেই বিপদে পড়েছে। এবার হজরত ওমর (রাঃ) হজরত আবুজর (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেন না চেনা সত্ত্বেও এমন জামিনদার হলেন? উত্তরে আবুজর গিফারী (রাঃ) বললেন পরবর্তীতে কেউ যেন বলতে না পারে এক মুসলমান বিপদে পড়েছিল কিন্তু অন্য মুসলমান তাকে সাহায্য করতে আসেনি।
এমন কথা শুনে বৃদ্ধের সন্তানদের মধ্যে একজন হঠাৎ করে বলে উঠল হে খলিফা, আপনি উনাকে মুক্ত করে দিন। আমরা তার উপর করা অভিযোগ তুলে নিলাম। হজরত ওমর (রাঃ) বললেন, কেন? উত্তরে সে বলল, কেউ যেন বলতে না পারে এক মুসলমান অনাকাঙ্খিতভাবে ভুল করে স্বীকার করার পরও অন্য মুসলমান তাকে ক্ষমা করেনি।এরপর খলিফা ওমরের আরকিছু বলার থাকলো না। তিনি নীরবে অশ্রুপাত করে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন।
লেখক: সহ-সভাপতি সিলেট প্রেস ক্লাভ
সিলেট৭১নিউজ /টিআর