ছাতক প্রতিনিধি:: নেই বিশুদ্ধ খাবার পানি। গত দুই মাস ধরে পানি সংকটে কষ্ট করেছেন এ উপজেলার লাখ লাখ মানুষ। বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য গ্রামে গ্রামে চলছে হাহাকার। ১৬ হাজার টিউবওয়েল গুলোর মধ্যে বেশীভাগই টিউবওয়েল পানি উঠছে না। তীব্র খাবার পানির সংকটে পড়েছে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলাবাসী। সরকারি ও বেসরকারি ভাবে প্রায় ১৬ হাজারের মতো টিউবওয়েল রয়েছে এ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পড়েছেন এখানে।
ছাতকে ১৩টি ইউনিয়ন বিভিন্ন গ্রাম এলাকার লাখো সাধারন মানুষ সুপেয় পানির অভাবে জীবন জীবিকা চরম মানবেতর যাপন করছেন। খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়ার কারনে নিরবেই চলছে ছাতকে হাহাকার। অনেকটা বাধ্য হয়ে স্থানীয়রা খাল বিল হাওর ওপুকুরের পানি ব্যবহার করছেন। অনেকে আবার কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে প্রতিদিন সকালে থেকে নারী পুরুষসহ নানা শ্রেনীর মানুষ কলস বালতি দিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন। পানির অভাবে গোসলসহ দৈনন্দিন কাজকর্ম সারতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে হতদরিদ্র মানুষগুলো।
ছাতকে ১৩টি ইউপির ও একটি পৌর এলাকাসহ ৫শদ৩১টি গ্রামের মধ্যে প্রায় তিন শতাধিক গ্রামে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পানির সংকট কাটাতে ৬শদমতো গভীর নলকুপ স্থাপন করার উদ্যোগে নেন সরকারি।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ১৬ হাজার প্রত্যন্ত অঞ্চলের টিউবওয়েলগুলোতে থেকে পানি না উঠায় কারনে গ্রামাঞ্চলের লাখো আজ চরম বিপাকে সাধারন মানুষ পড়েছেন। সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়েই নদী খাল ও পুকুরের ময়লা পানি ফুটিয়ে পান করছেন এবং ব্যবহার করছেন দৈনন্দিন কাজেও। অনেকেই আবার কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে কাঁধে কিংবা মাথায় করে নিয়ে আসছেন বিশুদ্ধখাবার পানি। ১৩ ইউনিয়নের প্রায় ১৬ হাজার টিউবওয়েল মধ্যে বেশী ভাগ নলকূপ অকেজো ও নানা সমস্যা নষ্ট হয়ে গেছে। চার ভাগে এক ভাগ থেকে নলকুপের খাবার কোনো পানি মিলছে না। মাটির নিচের পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাওয়ার কারণে টিউবওয়েল গুলো দিয়ে পানি উঠছে না। অধিকাংশ গ্রামে গভীব নলকুপ না থাকায় বছরের ২/৩মাস বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে চললে ও বাকী সময় খাবার পানির জন্য হাহাকার চলতে থাকে। সুপেয় পানির সংকট উপজেলার বেশীভাগই গ্রামেই হচ্ছে।
এসব সংকটের পরিস্থিতিতে স্থানীয় এমপি, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানের বরাদ্ধ করা গভীর নলকূপ অনেক দলীয় প্রভাবশালীরা পেলে ও গ্রাম পাড়া মহল্লাবাসীকে খাবার পানি ও দিচ্ছে না বলে ও হতদরিদ্র একাধিক মানুষ এসব অভিযোগ করছেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, খাল, বিল, জলাশয় ভরাট ও দখলের কারণে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ খালে পানি নেই। নদী গুলো এখন মৃতপ্রায়। এছাড়াও নিচু ও কৃষিজমি মাটি এবং বালু ফেলে ভরাট করে ফেলায় পানির স্তর অনেক নিচে তলিয়ে গেছে। এতে করে ১৫-২০ বছর আগে যে টিউবওয়েলগুলো বসানো হয়েছিল সেগুলো দিয়ে এখন পানি উঠছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ২০১৩ সালে নলকুপের উপর একটি জরিপ করা হয়। এর পর থেকে কোনো জরিপ হয়নি। গত ২০১৬,১৭ সাল থেকে ৬শত থেকে ৭শ ফুট ফিট পর্যন্ত পাইপ মাটির নিচে দেয়ার পর পানির নাগাল মিলছে। নলকূপ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠাকারীদের বিরুদ্ধে নানা চুরি, দুনীতি ও অনিয়মের কারনে সংকট দেখা দেয়। সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প মানুষের কল্যানে আসছে না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেকের বাড়ির নলকূপ দিয়ে এখন আর পানি ওঠে না।
জানা যায়, ছাতক উপজেলাকে প্রাচীনকাল থেকে অগাধ ভাটি এলাকা ও কালীদহ সাগরের অংশ বলে ইতিহাসে উল্লেখ্য করা হয়। এক সময় লাউড় ও কামরূপ রাজ্যের অধীনে ছিল ছাতক। মধ্যযুগে এ উপজেলাকে ভূ-ভাগ গড়ে উঠে বলে ধারনা করা হয়। তাৎকালীন সময়ে প্রাকৃতিক পরিবতন ও পরিবধনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে অনেক টিলা খাল, বিল, পুকুরসহ বিভিন্ন জলাশয় ভরাট করে কৃষি ও নিচু জমি মাটি ও বালু ফেলে ভরাট করে ফেলা। নদী, খাল,বিল হাওরসহ জলাশয় কুয়া পুকুর হয়েছে। কিছু কিছু ও উচ্চ জায়গা বাদ দিলে ও অদ্যবধি বষাকালে এ উপজেলা অঞ্চলকে একটি জলাশয় এলাকা হিসাবে চিহৃ করা হয় সুলতানি আমল থেকে। জেলা ও উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর বলছে, অসংখ্য সাব-মার্সিবল পাম্প স্থাপন ও ফসলি জমিতে সেচ ও গভীর নলকূপগুলোর জন্যই মূলত পানির স্তর অনেক নিচে নেমেযাওয়ায় অগভীর টিউবওয়েলগুলোতে পানি সংকট দেখাদিয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার উত্তর খুরমা, দক্ষিন খুরমা, দোলারবাজার, ভাতগাও, সিংচাপইড়, চরমহল্লা, কালারুকা, ছৈলাআফজলাবাদ, গোবিন্দগঞ্জ সৈদেরগাও, ছাতক সদর, নোয়ারাই, ইসলামপুর, জাউয়াবাজার ও ইসলামপুর ইউপিরসহ ৫শত ৩১টি গ্রামের মধ্যে প্রায় তিন শতাধিক গ্রাম পাড়া মহল্লা, মসজিদ, মাদ্রাসা, গোবিন্দগঞ্জ নতুন বাজার, স্কুল কলেজ গুলোতে বিশুদ্ধ পানির মারাতœক সংকট দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্যমতে, সরকারি হিসাবে সাড়ে ৫শথর মতো গভীর নলকূপ, তারা পাম্প যা ৬-৭শ ফুট গভীর। এ বছরের গভীর তারা পাম্প ৬শটি মতো স্থাপন করছেন সরকার। যা ৬শ থেকে সাড়ে ৭শ ফুট গভীর থাকবে। অসংখ্য সাব-মার্সিবল পাম্প স্থাপন ও ফসলি জমিতে সেচ ও গভীর নলকূপগুলোর জন্যই মূলত পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর টিউবওয়েলগুলোতে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। বিশুদ্ধ পানি সংকট সমস্যার সমাধানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছেন বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে জাউয়াবাজার ইউপির মুলতান পুর গ্রামের ক্বারী মাওলানা জুনায়েদ আহমদ জানান, তার বাড়িতে ১৫ বছর আগে একটি টিউবওয়েল বসানো হয়। তখন টিউবওয়েল বসালে মাটির নিচে ৫শত ফিট পর্যন্ত পাইপ দিলেই সুপেয় পানি উঠত। এখন আর উঠছে না।
এ ব্যাপারে গোবিন্দগঞ্জ নতুন বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি অলিউর রহমান জানান, পানির সংকট এখন গ্রামের পর গ্রামে। আগে এত খাবার পানি সংকট হয়নি। এ বছর গ্রামের প্রতিটি টিউবওয়েলই অকেজো। টিউবওয়েলের হাতল ধরে অনেকক্ষণ চাপাচাপি করলেও পানি আসছে না। পানির জন্য আমরা বাজার ও গ্রামে খুব কষ্ট হচ্ছে। এব্যাপারে মোহনপুর গ্রামের প্রতাপ বাবু জানান, এখন পুকুরের পানিতেই জীবন বাঁচাতে হচ্ছে। আমরা সামর্থ্য নেই, থাকলেও তো গভীরনলকূপ স্থাপন করতাম।
উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বলেন, মাস খানেক ধরে কোনো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। এমনকি ধানের জমিতে দেয়ার মেশিনেও পানি উঠছে না। পুকুর, ডোবার পানি গরম করে খাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে আমরা নানা ধরনের রোগ-বালাইয়ে পড়েছে। দশঘর গ্রামের শিক্ষক রেজাদ্দ আহমদ জানান, এ বছরের মতো আর কখনো পানি সংকটে পড়িনি।
এ ব্যাপারের উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের উপসহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপন করা সাড়ে ৩শত থেকে সাড়ে ৪শত ফুট গভীর নলকূপগুলো থেকে পানি উঠছে না। সরকারিভাবে স্থাপন করা গভীর তারা পাম্পগুলোতে অনেকটাই পানি উঠছে না। এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। টিউবওয়েলে পানি না আসার বিষয়টি লোকজন তাকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জানাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুনুর রহমান জানান, খাবার পানির সংকটে বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সঙ্গে আলাপ করে বিশুদ্ধ পানি সংকট সমস্যা সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এবিএ/২২ মার্চ