সিলেট৭১নিউজ ডেস্ক;: ফেঞ্চুগঞ্জের শাহজালাল ফার্টিলাইজার সারকারখানা প্রকল্পের হিসাব বিভাগীয় প্রধান খোন্দকার মুহাম্মদ ইকবাল সিদ্ধেশ্বরী, বনশ্রীসহ রাজধানী ঢাকার ৪টি স্থানে অন্তত ১০টি অত্যাধুনিক ফ্ল্যাটের মালিক। কাকরাইল ও মালিবাগে রয়েছে ভূমিসহ ভবন। কেবল রাজধানী ঢাকা নয়; তার নিজ এলাকা ফেনীতেও রয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ। কোম্পানির টাকা আত্মসাৎ করে তিনি নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকে’র প্রাথমিক তদন্তেও তার অবৈধ সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শাহজালাল ফার্টিলাইজার সার কারখানা প্রকল্পের (বর্তমানে বরখাস্ত) হিসাব বিভাগীয় প্রধান খোন্দকার মুহাম্মদ ইকবাল শুধু রাজধানী ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতেই ১১’শ বর্গফুটের ৫টি ফ্ল্যাটের মালিক। কেবল সিদ্ধেশ্বরী নয়; রাজধানীর বনশ্রীতে রয়েছে তার ৩টি ফ্ল্যাট। এছাড়াও রাজধানীর খিলগাঁও ও বাসাবো’তে আরও ১টি করে অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট রয়েছে। অবৈধ অর্থ দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেই ক্ষান্ত হননি ইকবাল। রাজধানীর কাকরাইল ও মালিবাগে ভূমিসহ ভবনও কিনেছেন। এই ভবন দু’টি ভাড়া দেয়া হয়েছে, দু’টি ভবনেই চালু রয়েছে রেস্টুরেন্ট ও খাবার দোকান। রাজধানীতে রয়েছে-তার ৪ টি চেইন শপ। রাজধানীর বিভিন্ন রেন্ট-এ কারের মাধ্যমে ভাড়া দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অন্তত ৪০টি গাড়ি। নিজ এলাকা ফেনীর পরশুরাম উপজেলাসহ ফেনীতেও নামে-বেনামে অনেক সম্পদ রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
গত মঙ্গলবার দায়েরকৃত দুদকের মামলাগুলোর এজাহার পর্যালোচনায় খোন্দকার ইকবালের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। খোন্দকার ইকবালসহ লুটেরা এই চক্রটির বিরুদ্ধে ১৩ কোটি ৬৭ লাখ ৫ হাজার ৪৫৬ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ১১টি মামলা দায়ের করে দুদক। আত্মসাৎ করা এই ১৩ কোটি ৬৭ লাখ ৫ হাজার ৪৫৬ টাকার মধ্যে খোন্দকার ইকবাল ও তার স্ত্রী হালিমা এবং শ্যালক জামসেদুর রহমান মিলে ১২ কোটি ৪৪ লাখ ৯১ হাজার ৯৩৩ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে ইকবাল ও তার স্ত্রী হালিমা মিলে আত্মসাৎ করেছেন ১০ কোটি ৩০ লাখ ৯৪ হাজার ১৮৬ টাকা। স্ত্রী হালিমা আক্তার মেসার্স নুসরাত ট্রেডার্স, মেসার্স টি.আই ইন্টারন্যাশনাল ও ইউটোপিয়া প্রোপার্টিজ নামের ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। শ্যালক জামসেদুর রহমান খোন্দকারের ড্যাফোডিলস ইন্টারন্যাশনাল নামের আরও একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্ত্রী হালিমা আক্তারের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, ৮৬/৪ সিদ্ধেশ্বরী রোড, রমনা, ঢাকা। একই ঠিকানা খোন্দকার ইকবালেরও। মূলত নিজ বাসার ঠিকানা দিয়েই খোন্দকার ইকবাল নিজের স্ত্রী হালিমা আক্তারের নামে গড়ে তুলেন নাম সর্বস্ব তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
এর আগে গত ৪ আগস্ট ইকবাল, তার স্ত্রী হালিমা, শ্যালক জামসেদুর রহমানসহ ওই চক্রটির বিরুদ্ধে ৩৮ কোটি ৭১ লাখ ২৪ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় আরও ১৫টি মামলা দায়ের করেছে দুদক। মোট ৫২ কোটি ৩৮ লাখ ৫ হাজার ৪৮০ টাকা আত্মসাৎ করেছে খোন্দকার ইকবাল চক্র।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার দায়েরকৃত ১১ টি মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, খোন্দকার ইকবাল ও তার শ্যালক জামসেদুর রহমান খোন্দকার দুটি চেকে ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা ও আরও দুটি চেকে ৬৬ লাখ ১৮ হাজার ৪৩৫ টাকাসহ ৪ চেকে মোট ৭২ লাখ ৫ হাজার ৯৩৫ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। কেবল শালা-দুলাভাই মিলে এই টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলন করেই থেমে যাননি ইকবাল। নিজের নামে ২১টি চেকে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৮৫ হাজার ৬৬২ টাকা ও আরেকটি চেকে ২ লাখ ৬ হাজার ১৫০ টাকাসহ মোট ১ কোটি ৪১ লাখ ৯১ হাজার ৮১২ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। এরপর স্ত্রী হালিমা আক্তার ও খোন্দকার ইকবাল মিলে ১৮টি চেকে ৪ কোটি ৮৮ লাখ ২৮ হাজার ৭৭০ টাকা, ৬টি চেকে ৩ কোটি ৫ লাখ ৬৮ হাজার ২৫৫ টাকা ও ৪টি চেকে ২ কোটি ৩৬ লাখ ৯৭ হাজার ১৬১ টাকা আত্মসাৎ করেন ইকবাল।
একটি সূত্র জানিয়েছে, ১৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকার মধ্যে যদি ১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন ইকবাল; তাহলে বাকি ৩৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার মধ্যে খোন্দকার ইকবাল কি পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছে তা সহজেই অনুমেয়। দুদকের তদন্তে খোন্দকার ইকবাল, তার স্ত্রী হালিমা আক্তার ও শ্যালক জামসেদুর রহমান মোট কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন তা বেরিয়ে আসবে বলে সূত্র জানায়।
শাহজালাল ফার্টিলাইজার প্রকল্পের অনুকূলে জনতা ব্যাংক লি. কর্পোরেট শাখা, দিলকুশা, ঢাকায় পরিচালিত একাউন্ট থেকে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খোন্দকার ইকবালের নেতৃত্বে একটি দুর্নীতিবাজ চক্র ভুয়া বিল-ভাউচার ও জালিয়াতির মাধ্যমে এই টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। এই টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দুদকের দায়েরকৃত মামলাসমূহে সাবেক সহকারী প্রধান হিসাবরক্ষক ও হিসাব বিভাগীয় প্রধান (বর্তমানে বরখাস্ত) খোন্দকার মুহাম্মদ ইকবাল, প্রকল্পের সাবেক রসায়নবিদ (বর্তমানে বরখাস্ত ) নেছার উদ্দিন আহমদ, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স নুসরাত ট্রেডার্স, মেসার্স টি.আই ইন্টারন্যাশনাল ও ইউটোপিয়া প্রোপার্টিজ এর মালিক খোন্দকার ইকবালের স্ত্রী হালিমা আক্তার, মেসার্স ড্যাফোডিলস ইন্টারন্যাশনালের মালিক ও খোন্দকার ইকবালের শ্যালক জামসেদুর রহমান খোন্দকার, মেসার্স রাফী এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. নুরুল হোসেন, ফাল্গুনী ট্রেডার্সের এমডি এএসএম ইসমাইল খান, মেসার্স আয়মান এন্টারপ্রাইজের মালিক সাইফুল হক, মেসার্স এন আহমদ অ্যান্ড সন্সের মালিক নাজির আহমদ (বচন), মেসার্স মা এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হেলাল উদ্দিন, মেসার্স সাকিব ট্রেডার্সের মালিক মো. আহসান উল্লাহ চৌধুরী ও মেসার্স সানশাইন আইটি সল্যুউশনের মালিক মাসুদ রানাকে আসামি করা হয়। দন্ডবিধির ৪০৬/৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলাগুলো দায়ের করে দুদক।
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় সিলেটের উপপরিচালক মো. নূর-ই-আলম জানিয়েছেন, দুদকের প্রাথমিক তদন্তে খোন্দকার ইকবাল, তার স্ত্রী হালিমা আক্তার, শ্যালক জামসেদুর রহমানসহ চক্রটির অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। খোন্দকার ইকবালের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। চক্রটির বিরুদ্ধে মোট ২৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তারা ৫২ কোটি টাকারও বেশি টাকা অবৈধভাবে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছে
আইআর/২১ ফেব্রুয়ারি