সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি;: ইউরোপ যাবার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশি হাজার হাজার তরুণ-যুবকেরা। আর সেই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে দালালদের হাতে পরে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন তারা।
ঠিক তেমনি ইউরোপের গ্রিসে যাবার প্রলোভনে দালালের খপ্পরে পড়ে ইউরোপ যাবার পথেই চির বিদায় নিতে হল সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের তিন যুবকে। বিদেশে ভালো বেতনে কাজের আশায় যে কোনো উপায়েই হোক স্বপ্নের দেশ গ্রিস যেতে চেয়েছিলেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার সেই ৩ যুবক। এর জন্য উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের টুকদিরাই গ্রামের হাজি আব্দুল ওয়াহেদ মিয়ার ছেলে মানবপাচারকারী (দালাল) চক্রের সদস্য এনামুল হকের সাথে চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক তাদের কাছ থেকে জন প্রতি বাংলাদেশ থেকে দুবাই ২ লাখ টাকা, দুবাই থেকে ইরান ৩ লাখ টাকা, ইরান থেকে তুরস্ক ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও তুরস্ক থেকে গ্রিস পর্যন্ত আরও সাড়ে ৩ লাখ টাকা নেয় পাচারকারী এনামুল।
আর সেই চুক্তি মোতাবেক গ্রিস যাওয়ার পথে প্রাণ দিতে হল তিন যুবকে। তারা হলেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের সাকিতপুর গ্রামের ফুল মিয়া সর্দারের ছেলে জনি সর্দার (৩৪), একই ইউনিয়নের নতুন কর্ণগাঁও গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে জুনেদ আহমদ (২২), এবং শাল্লা উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের আশুতোষ রায়ের ছেলে আকাশ রায় (২৫)। তবে আকাশ রায় দিরাই পৌর শহরের রায় মেশিনারিতে কয়েক বছর ধরে কাজ করে আসছিল।
আকাশের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে তার ভগ্নিপতি নিলেন্দু রায় বলেন, লন্ডন থেকে তাদের পরিচিত একজন তুরস্কে গিয়ে মর্গ হতে আকাশের মৃত্যের ছবি পাঠিয়ে দিলে আমরা ছবি দেখে নিশ্চিত হই আকাশ আর বেঁচে নেই। তিনি আর বলেন,চার ভাই বোনের মধ্যে আকাশ তৃতীয়। অভাব অনটনের সংসারে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে আকাশ। সে দিরাই পৌর শহরের রায় মেশিনারিতে কাজ করত সেই সুবাদে পরিচয় হয় টুকদিরাই গ্রামের দালাল এনামুল হকের সঙ্গে। এনামুল হক টাকার বিনিময়ে তাঁকে খুব সহজে গ্রিসে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। ইউরোপে যেতে পারলে অভাবের জীবন বদলে যাবে এমন স্বপ্ন দেখতে থাকেন আকাশ। পরে মা-বাবাসহ আত্নীয় স্বজনদের বুঝিয়ে টাকা জোগাড় করে দালালের হাতে তুলে দেয়।
তিনি আর বলেন, দালাল এনামুল হক আকাশের মামার কাছে চুক্তির ৫ লক্ষ টাকা ফেরত দিয়েছে।
জুনেদ আহমদের মৃত্যের বিষয়টি নিশ্চিত করে তার চাচাত ভাই ছদরুল ইসলাম বলেন, জুনেদের লাশ আনার প্রসেসিং চলছে আশা করি ৪/৫ দিনের মধ্যেই লাশ চলে আসবে।
ইউরোপ যাওয়ার বিষয়ে নিহত যুবক জুনেদ আহমেদের পিতা লাল মিয়া বলেন, আমার ছেলেকে দুবাই-ইরান হয়ে তুরস্ক পৌঁছায় এনামুল। গত ৩১ জানুয়ারি সোমবার আমার ছেলের সাথে শেষবার কথা হয়। তুরস্ক থেকে এনামুলের লোকজন গাড়িতে করে গ্রিসে পৌঁছে দিবে জানিয়ে আমার ছেলে এনামুলের টাকা দিয়ে দিতে বলে। ওইদিনই দিরাই বাজারে বিধান রায়ের দোকানে বসে আমার ছেলে জুনেদ ও বিধান রায়ের ভাগ্নের তুরস্ক থেকে গ্রিসে পৌঁছে দেয়া বাবদ সর্বশেষ চুক্তির মোট ৭ লাখ টাকা আমি ও বিধান বাবু এনামুলের ভাগ্নে শাহজাহান-এর হাতে তুলে দেই।
এদিকে জনি সর্দারের লাশ রবিবার ১৩ ফেব্রুয়ারি দেশে এসে পৌঁছে। সোমবার সকাল ১১টায় তাঁর গ্রামের বাড়ী করিমপুর ইউনিয়নের সাকিতপুর গ্রামে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
এ বিষয়ে মানবপাচারকারী (দালাল) চক্রের সদস্য এনামুল হকের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান আমি এখন ঘুমে আছি পরে আপনার সাথে কথা বলছি। এক ঘন্টাপর এনামুল হক কল বেক করে বলেন এরা আমার পেসিঞ্জার না।
আকাশ এরা আপনার পেসিঞ্জার না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন তাদেরকে ইরান পর্যন্ত পৌঁছানো আমার দায়িত্বে ছিল। বাকি পথ তাদের অন্য দালাল মারফতে যাবার কথা।
প্রসঙ্গ, গত ২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বিমানযোগে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দুবাইয়ের একটি শহরে তার পর ইরানে নেওয়া হয়। এরপর তুরস্কে। গত ৩১ জানুয়ারি রাতের দিকে নিহত যুবকদের সাথে সর্বশেষ কথা হয় তাদের পরিবারের সদস্যদের। তখনই তাদেরকে তুরস্ক থেকে গ্রিসে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু এর পর থেকে শতচেষ্টা করেও তাদের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারেনি তাদের পরিবার।
অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ২ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক-গ্রিস সীমান্ত থেকে ১২জন অভিবাসন প্রত্যাশীর লাশ উদ্ধার করেছে তুরস্কের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এমন একটি খবর ছড়ায়। তাদের পরিবারের সদস্যরা দাবী করে আসছিলেন ২২ জনের দলটিতে ছিলেন তারাদের সন্তানরাও কিন্তু তারা তাদের সন্তানের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারছিলেনা।
আইআর/১৪ ফেব্রুয়ারি