সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:: সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় উড়ালসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সুনামগঞ্জের উন্নয়নে নেওয়া এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ প্রকল্প এটি। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি বাস্তবায়িত হলে হাওর এলাকার ‘রূপ’ বদলে যাবে, ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এ জনপদের মানুষের জীবনমানে। এ উড়ালসড়ক আলো ছড়াবে দেশের উত্তর-পূর্ব কোণে।
এই প্রকল্পে হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জের সঙ্গে নেত্রকোনা জেলার আধুনিক যোগাযোগ স্থাপন, দুই জেলার পাঁচটি উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন, হাওর এলাকার ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষিপণ্য ও মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দ্রততম সময় ও সহজে পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত, হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনের প্রসার থাকবে।
গত বছরের ২৪ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) ‘হাওর এলাকায় উড়ালসড়ক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ অনুমোদিত হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এবং সেতু বিভাগকে সমন্বয় করতে একনেক সভায় নির্দেশনা দিয়েছেন। ২০২৫ সালের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা। চলতি বছরে প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু হবে।
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা এবং নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলাজুড়ে এ প্রকল্পের কাজ হবে। উড়ালসড়ক শুরু হবে জামালগঞ্জের সাচনা এলাকা থেকে। এরপর উপজেলার কাজীরগাঁও হয়ে ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী, ধর্মপাশা বাজার, ধর্মপাশার আলোকদিয়া হয়ে বারহাট্টা উপজেলার গোপালপুরে সড়কে গিয়ে যুক্ত হবে। এটিই প্রকল্পের মূল সড়ক, যার দৈর্ঘ্য হবে ২৮ কিলোমিটার। এ ২৮ কিলোমিটারের মধ্যে উড়ালসড়ক হবে ১০ দশমিক ৮১ কিলোমিটার। এ সড়কের বাকিটুকু হবে সব মৌসুমে যাতায়াতের সড়ক। উড়ালসড়ক যাবে গ্রামের পাশ দিয়ে। সড়কের প্রস্থ হবে ৩০ মিটার, তবে এটা আরও বাড়তে পারে।
দৃষ্টিনন্দন সড়কের বিভিন্ন স্থানে পর্যটকদের জন্য সাতটি দোতলা টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। একই সঙ্গে এক কিলোমিটার পরপর সড়কের পাশেই পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানো এবং যানবাহন রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা (বাস-বে) থাকবে। যেখানে সম্ভব সড়কের দুই পাশে হিজল ও করচগাছ লাগানো হবে। হাওরে প্রাণ-প্রকৃতির বিষয়টি মাথায় রেখে উন্নত বিশ্বের আদলে থাকবে শব্দ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা।
মূল সড়ক ছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় সব মৌসুমে যাতায়াতের সুবিধাসহ উপজেলা পর্যায়ে সড়ক হবে ৯৭ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার, ইউনিয়ন পর্যায়ে সড়ক হবে ২০ দশমিক ২৭ কিলোমিটার, উপজেলায় সড়ক (ডুবন্ত) ১৬ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার, ইউনিয়ন ও গ্রামপর্যায়ে সড়ক (ডুবন্ত) হবে ২২ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার। ডুবন্ত বা সাবমার্সিবল সড়কে মানুষ ও যানবাহন চলাচল করবে শুকনা মৌসুমে। বর্ষায় এসব সড়ক থাকবে পানির নিচে। এ ছাড়া ৫৭টি সেতু ও ১১৮টি কালভার্ট নির্মিত হবে, যার মোট দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৬৮৮ কিলোমিটার। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সুরমা নদীর জামালগঞ্জ-সাচনা বাজার এলাকায় একটি সেতু নির্মিত হবে। এ উড়ালসড়ক হলে সুনামগঞ্জের মানুষ নেত্রকোনা হয়ে সাড়ে চার ঘণ্টায় ঢাকায় যেতে পারবে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা সফরে এসেছিলেন। তখন হাওর এলাকার অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কথা তুলে ধরেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের (তাহিরপুর, ধর্মপাশা ও জামালগঞ্জ) সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন। সেদিন প্রধানমন্ত্রী হাওরে উড়ালসড়ক নির্মাণের বিষয়টি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত প্রকল্প উল্লেখ করে সুনামগঞ্জের বাসিন্দা পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সেদিন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মঞ্চ করা হয়েছিল হাওরে ভাসমান নৌকায়। তিনি হাওরের অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার বিষয়টি চিন্তা করেই তখন উড়ালসড়ক নির্মাণ করা যায় কি না, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাবতে বলেছিলেন।
এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর এম এ মান্নান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। একইভাবে স্থানীয় সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনও এ কাজে ভূমিকা রাখেন। এরপর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এটি নিয়ে কাজ শুরু করে। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের উত্তর-পূর্ব কোণে আলো জ্বলবে। হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। প্রধানমন্ত্রী চান পুরো দেশকে আলোকিত করতে। এ কারণেই তিনি হাওর, পাহাড়, সমতল, চরাঞ্চলসহ সব এলাকার উন্নয়নে কাজ করছেন।
এবিএ/ ০৩ ফেব্রুয়ারী