শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি:: মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের লোকালয়ে এসে প্রাণ হারালো বিপন্ন গন্ধগোকুল। সোমবার তার মরদেহ পড়েছিল সড়কের পাশে। গহীন বনে থাকার কথা থাকলেও কিছু প্রাণীরা নানা কারণে বনে থাকছে না। চলে আসছে লোকালয়ে। জনসম্মুখে আসা বন্যপ্রাণীদের দেখে আতংকিত হয়ে পড়েন অনেকে।
এই প্রাণীকে দেখে কেউ কেউ দারুণভাবে ভয়ে হয়ে তাদের প্রাণেও মারতে চান। লোকালয়ে আসা প্রাণীদের মধ্যে গন্ধগোকুল অন্যতম। সোমবার সকালে একটি গন্ধগোকুলকে মরে পড়ে থাকতে দেখে বনবিভাগকে খবর দেওয়া হয়। পরে বনবিভাগ এসে প্রাণীটিকে নিয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গভীর রাতে শ্রীমঙ্গল শহরের গুহ রোডে রাস্তা অতিক্রমের সময় চলন্ত গাড়ির সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খেয়ে সে প্রাণ হারায়। ওর শরীর থেকে পোলাও চালের মতো গন্ধ বের হচ্ছিল।
সন্ধ্যার পর পর আত্মগোপনে থাকা অবস্থা থেকে তারা শহরের দিকে বের হয়ে আসে। টিনসেড বাড়ির চালে কিংবা বিল্ডিং বাড়ির ছাদে তারা কখনো জোড়ায়, কখনো একা খাদ্য সংগ্রহের সন্ধানে ঘুরাঘুরি করে। তখনি মানুষের নগরে পড়ে।
মানুষের তাড়া খেয়ে আত্মরক্ষায় এদিক-ওদিক ছুটাছুটির একপর্যায়ে বৈদ্যুতিক তারে, গাড়ির চাকায় কিংবা অন্য কোনোভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারায়। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, শনিবার (১৫ জানুয়ারি) হবিগঞ্জের একটি বাসার চালে গন্ধগোকুল বাচ্চা দিয়েছে। এ প্রাণীটিকে দেখে মানুষ আতংকিত হয়ে যায়। প্রাণীটিও আত্মারক্ষার্থে মুখ বাকিয়ে ভয় দেখানো চেষ্টা করে। তখন মানুষ আরো উৎসুক হয়ে প্রাণীটিকে অশান্ত করে তুলে।
শ্রীমঙ্গলের গুহরোড থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধারকৃত গন্ধগোকুলটিকে ময়নাতদন্তের পর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্ত্বাবধানে মাটি চাপা দেওয়া হবে বলে জানান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) লাল তালিকায় এই প্রাণীটি ‘বিপদাপন্ন’ তালিকাভুক্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বন্যপ্রাণী গবেষক মুনতাসির আকাশ সাংবাদিকদের বলেন, এটার ইংরেজি নাম ঈড়সসড়হ চধষস ঈরাবঃ এবং বাংলা নাম গন্ধগোকুল বা এশীয় তাল খাটাশ। এরা ছোট আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী। নাকের আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত ৯২-১১২ সেন্টিমিটার, এর মধ্যে লেজই ৪৪-৫৩ সেন্টিমিটার। ওজন আড়াই থেকে ৫ কেজি হয়ে থাকে।
পোলাও চালের মতো গন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে গন্ধগ্রন্থি থাকে। গন্ধগোকুলের গাট্টাগোট্টা দেহটি স্থূল ও রুক্ষ বাদামি-ধূসর বা ধূসর-কালো লোমে আবৃত। ওর লেজের নিচে একটি বিশেষ গ্রন্থি রয়েছে। যা দিয়ে সে অনেকটা পোলাওয়ের চালের মতো এক প্রকারের গন্ধ ছড়ায়। গন্ধগোকুলের ধূসর রঙের এই প্রাণীটির অন্ধকারে অন্য প্রাণীর গায়ের গন্ধ শুঁকে চিনতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। পোলাও চালের মতো তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে থাকে।
এদের শরীরের গন্ধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে কৃত্রিম বিকল্প সুগন্ধি তৈরি হয়।
তিনি আরো বলেন, গন্ধগোকুল নিশাচর। খাটাশের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে এরাই মানুষের বেশি কাছাকাছি থাকে। দিনের বেলা বড় কোনো গাছের ভূমি সমান্তরাল ডালে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে, লেজটি ঝুলে থাকে নিচের দিকে। মূলত ফলখেকো হলেও কীটপতঙ্গ, শামুক, ডিম-বাচ্চা-পাখি, ছোট প্রাণী, তাল-খেজুরের রসও খায়।
অন্য খাদ্যের অভাবে মুরগি-কবুতর ও ফল চুরি করে। এরা ইঁদুর ও ফল-ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের উপকার করে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মুনতাসির আকাশ।
এবিএ/১৮ জানুয়ারি