দোয়ারাবাজার(সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ যুগ যুগ ধরে একমাত্র বোরো ফসলি জমির ওপর নির্ভর করেই কোনোরকমে চলতো হাওরপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা। তার পরেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানির কারণে প্রায়ই লোকসান গুণতে হতো তাঁদের। ঘরে ঘরে দারিদ্র্যতা ও বেকারত্ব লেগেই থাকতো। কাজের সন্ধানে দলে দলে গ্রামের বেকার যুবকরা ঢাকামুখী হতেন। আবার অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমান। তবুও কাটতো না তাদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা। তবে হাওরপাড়ের এই বেহাল দৃশ্যপট এখন পাল্টে গেছে।
বানিজ্যিকভাবে মাছচাষ করে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার প্রত্যন্ত হাওরপাড়ের যুবকরা এখন স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাছ উৎপাদন, আহরণ, পরিবহন এবং বাজারজাতকরণ কাজে শতশত বেকার যুবকের সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান। পাশাপাশি মিটছে আমিষের চাহিদাও।
উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামের যুবক সোহেল আহমদ অর্থনৈতিক টানাপোড়নে কর্মসংস্থানের জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন সুদূর মালয়েশিয়ায়। সেখানে প্রায় এক দশক প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করেছেন তিনি। ২০১৬ সালে বিদেশের চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে গ্রামে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেও ভাগ্যের চাকা পাল্টেনি তাঁর। পরে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে শুরু করেন বানিজ্যকভাবে মাছ চাষ। বর্তমানে তার ৩শ’ শতক জমির উপর বিশাল পুকুরসহ ছোট্টবড় ৪-৫টি পুকুর রয়েছে। সেখানে মাছ চাষ করে প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকা লাভবান হচ্ছেন তিনি।
সোহেল আহমদ বলেন, “প্রবাসে যে সময় ব্যয় করেছি দেশে কম সময়েও এখন অধিক উপার্জন করছি। বানিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করে আমি লাভবান। দেশে এখন পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে আছি। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মাছচাষের খামারকে আরও সম্প্রসারণ করা। শুধু সরকারি চাকরি আর বিদেশগামী না হয়ে দেশের প্রতিটি এলাকার যুবকদের প্রত্যেকের নিজ এলাকায় আত্মকর্মসংস্থান তৈরি করা উচিত।”
শুধু বিদেশফেরত যুবক সোহেল আহমদ একাই নয়, তাঁরমতো আলীপুর গ্রামের সিরাজ মিয়া, হাবীবুর রহমান, আব্দুস শহীদ, সজীব মিয়াসহ আশপাশ গ্রামের বেকার যুবকরা এখন মাছচাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। মাছচাষ ও ব্যবসায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ওই গ্রাম থেকে কয়েকজন মৎস্যখামারি একাধিকবার জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ মৎস্যচাষির স্বীকৃতি ও সম্মাননা পেয়েছেন। সুরমা ইউনিয়নের আলীপুর ছাড়াও নূরপুর, টেংরাটিলা, বৈঠাখাই, সোনাপুর ও নন্দীগ্রামে কনছখাই এবং কানলার হাওরপাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে শতশত বানিজ্যক মাছচাষের পুকুর। এসব পুকুরে চাষ হচ্ছে পাঙাশ, তেলাপিয়া, কাতলাসহ সকল প্রকার বিদেশি জাতের কার্প জাতীয় মাছ। গ্রামের প্রধান সড়ক ও হাওরের পাশে একের পর এক পুকুর দেখে মনে হয় প্রতিটি গ্রাম যেন পুকুরে ঘেরা।
আলীপুর গ্রামের বাসিন্দা জেলার শ্রেষ্ঠ মৎস্যচাষি সম্মাননা প্রাপ্ত আব্দুর রহিম ও নূরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশিক্ষণ ও সহজে ঋণ প্রাপ্তি এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে হাওরপাড়ে মৎস্যবিপ্লব ঘটবে। হাওরপাড়ের প্রত্যন্ত এলাকা হবে দেশের মাছ উৎপাদনের রোল মডেল।’
দোয়ারাবাজার উপজেলা মৎস্যকর্মকর্তা তুষার কান্তি বর্মন বলেন, “পুরো উপজেলায় ৪৬৬৬টি মাছ চাষের পুকুর রয়েছে। হাওরপাড়ে বানিজ্যিকভাবে মাছচাষের পুকুরের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে।সেখানকার আবহাওয়া ও মাটি মাছচাষে উপযোগী, যে কারণে সেখানে মাছের উৎপাদন হয় ভালো। আমরা মাছচাষিদেরকে মাছচাষে উদ্বুদ্ধ করতে সকল ধরনের পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করে আসছি।”
এবিএ/০৬ জানুয়ারি