স্টাফ রিপোর্ট:: চারদিকে টেরাম টেরাম গুলির শব্দ। গ্রামে গ্রামে আতঙ্ক। এই বুঝি গ্রামে ঢুকছে পাক হায়েনার দল ! তার উপর রাজাকার বাহিনীর সংঘবদ্ধ চক্র। সবকিছু মিলিয়ে ভালো যাচ্ছিলনা তরুণ সালামের মন। কিছু একটা করতে হবে। দেশকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু একা কিভাবে সম্ভব ? বাবা বাড়িতে নেই। তিনি চাকুরী করেন জাহাজে। বাবার সাথে চাকুরীতে আরো এক ভাই। তবুও থেমে থাকার পাত্র নন তিনি। যুদ্ধে যাবার সিদ্বান্ত নিলেন আপন মনে। সেই খবর পৌছে গেল বাবা খোর্শেদ লস্করের কাছে। খবর পেয়ে চাকুরীরত অপর ভাই খলিল লস্করও ছোটে আসেন বাড়িতে। ভাইয়ের সাথে তিনিও হাতে নিলেন অস্ত্র। পাক-বাহিনীর হাত থেকে দেশ রক্ষা হলো। কিন্তু সালাম-খলিল লস্করের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রতিদান দিতে হলো বাবা খোর্শেদ লস্করকে। দুই ভাইকে গ্রামে খুঁজে না পেয়ে পাকিস্তানীরা তাদের পিতা খোর্শেদ আলী লস্করকে গ্রামের ২৩ জনের সাথে ওপেন ব্রাশ ফায়ারে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
একাত্তরের এমন লোমহর্ষক কাহিনী সিলেটের গোলপগঞ্জের। গ্রামের নাম সুন্দিশাইল। ছবির মতো ছায়াঘেরা এক শান্তির পরশ ছিল গ্রামটিতে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীণ এই গ্রামেই ২৩ জনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে বিদায় দেয় পাকবাহিনীর দল।
সময়টি ৭১ সালের ২৪ /২৫ অক্টোবর। আবদুস সালামের বয়স তখন ২৪ অথবা ২৫ বছর হবে। পিতা খোর্শেদ আলী কাজ করতেন জাহাজে। ফলে সবাই সারেং লস্কর নামেই চিনতো। সালাম লস্করের আপন ভাই খলিলুর রহমান লস্করও চাকুরী করতেন। চাকুরী ছেড়ে ভাই সালামের সাথে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। চলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ। চলে প্রতিরোধ যুদ্ধ। রাজাকার সদস্যদের মাধ্যমে সেই খবর পৌছে যায় পাকবাহিনীর কাছে। এদিকে,পূরুষশূন্য বাড়ির খবর পেয়ে চাকুরী থেকে বিদায় নেন সালাম লস্করের পিতা খোর্শেদ লস্কর। অবস্থান করেন নিজ বাড়িতে। তারপর সালাম লস্করের খোঁজ নিতে পাকবাহিনীর দল সুন্দিশাইল গ্রামে ঢুকে। সালাম লস্কর বাড়ি না থাকায় ধরে নিয়ে যায় পিতা খোর্শেদ লস্করকে। দুই ছেলে মুক্তি বাহিনীতে যুক্ত থাকার অপরাধে পিতা খোর্শেদ আলী লস্করকে ওপেন ব্রাশ ফায়ারে প্রাণ দিতে হয় পাকিস্তানীদের হাতে।
যুদ্ধকালীণ মুক্তিবাহিনীর সকলের রান্নার আয়োজন করা হতো এই লস্কর বাড়ি থেকেই। রান্নার কাজ করে দিতেন তাদের বোন শেবু বেগম,সালাম লস্করের মা ও উনার স্ত্রী হালিমা খাতুন। রান্না করা খাবার মুক্তিবাহিনীর হাতে পৌছে দিতেন একই গ্রামের মৃত: মৌলা মিয়া লস্করসহ কয়েকজন। নানা বেশে সেই সব খাবার পৌছে যেতো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। এক সময় সেই খবরটিও গোপন থাকেনা, পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে সেই খবর প্রকাশ হয়ে যায়। তারপরই ঘটে সিলেটের ইতিহাসের এই নির্মম ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭৪ সালে আবদুস সালাম লস্করের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কবরস্থান খুড়ে হাড়-গোড় উদ্ধার করেন। পরে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পোস্ট মর্টেম করানো হয়। এই ঘটনার পর আবদুস সালাম লস্করের উদ্যোগে বিয়ানীবাজার থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় সাক্ষি করা হয় বর্তমানে কানাডা প্রবাসি আওয়ামী লীগ নেতা দিলু চৌধুরী। শুধু এখানেই শেষ নয়, গ্রামবাসীর পক্ষে থেকে ২৩ শহীদের সমাধীস্থল সংরক্ষণ করার দাবিতে গ্রামবাসী একাত্ব হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ড.সৈয়দ মকবুল হোসেনের হস্তক্ষেপ গ্রহণ করেন।
দায়িত্ব দেন সেসময়ের বাল্য বন্ধু আব্দুস সালাম লস্করসহ কয়েকজনকে। গ্রামবাসীকে নিয়ে সেখানে গড়ে উঠে একটি স্মৃতি সৌধ। জাতীয় দিবসগুলোতে সেখানে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়।
এদিকে, যুদ্ধ পরবর্তী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে একটি চিঠি পাঠান । সেই চিঠিতে প্রতিটি পরিবারের এই আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন তিনি। সেই সাথে পাঠান আর্থিক সম্মানীও। ঢেউটিন, কম্বলসহ সম্মাননা পাঠান সেইসব পরিবারে।বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বীকৃতি পেলেও এখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি গোলাপগঞ্জের এই ২৩টি পরিবার।
স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও সেই ২৩ পরিবারের ভাগ্যে জোটেনি রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি। বর্তমানে ২৩ শহিদের স্মৃতিসৌধে দিবসগুলোতে পুস্ফস্তবক অর্পন করা হয়। ২০০৭ সালে শহিদ পরিবারের কয়েক উদ্যমী তরুণ মিলে গড়ে তোলেন ‘২৩ শহিদ স্মৃতি সংসদ’ নামের একটি সংগঠন। ২০১০ সালে সেই সংগঠন সরকারি অনুমোদন লাভ করে।
এদিকে , জাতির পিতা থেকে প্রাপ্ত সম্মাননার এতোবছর পরও সেই পরিবারগুলোর ভাগ্যে জোটেনি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ২০১৪ সালে শহীদ পরিবার গুলোর পক্ষ থেকে মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বরাবরে একটি আবেদন পাঠানো হয়। এই আবেদনের ৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও সরকারি স্বীকৃতির আশায় প্রহর গুণছে শহীদ পরিবারের সন্তানেরা।
এ ব্যাপারে‘২৩ শহিদ স্মৃতি সংসদ’ এর সভাপতি এম এ ওয়াদুদ এমরুল বলেন, ‘আমরা গর্বিত যে, দেশমাতৃকার ডাকে সারা দিয়ে আমার গ্রামের লোকজন যুদ্ধ করেছে, এই অপরাধে গ্রামের লোকজনকে জীবন্ত অবস্থায় সারিবদ্ধভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা সেই সব দেশপ্রেমিকদের গর্বিত উত্তরসূরী।’ কিন্তু দূর্ভাগ্যের সাথে বলতে হয়, এখন পর্যন্ত ২৩ শহীদের সমাধীস্থল অরক্ষিত অবস্থায় আছে।
এ ব্যাপারে তিনি জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শহীদ খোর্শেদ আলীর নাতি এবং মুক্তিযোদ্ধের অন্যতমত সংগঠক আবদুস সালাম লস্করের বড় ছেলে সাবেক ইউপি সদস্য ও আমুড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ লস্কর মিন্টু বলেন, ‘আমার দাদা খোর্শেদ আলী ছিলেন সেই সময়ে পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ সেই অবলম্বনটুকু কেড়ে নিলেও দমে থাকেনি আমার পরিবার।
আমার বাবা আব্দুস সালাম লস্কর দাদাকে হারানোর পর সংসার নামক নতুন যুদ্ধ মোকাবেলা করেন’। তিনি বলেন, এই ত্যাগ আমার পরিবারের জন্য এবং গ্রামবাসীর জন্য অনেক গর্বের বিষয়। কিন্তু দুঃখ হয়, ২৩ পরিবারের অনেকেই এখনও মানবেতর জীবন- যাপন করছে।
তাদের খোঁজ রাখাটাও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। তিনি বলেন, আমরা শোক সহ্য করেছি-কিন্তু এখন চাই সেই ত্যাগের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তিনি জাতীর পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরী ও দেশের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ২৩ পরিবারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
একইভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, ২৩ শহীদের পরিবারের মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, দেশ আজ বিজয়ের ৫০ বছরে পর্দাপন করেছে। এই অবস্থায় ২৩ পরিবারেও বিজয়ের হাসিটুকু গ্রহণের সুযোগ দিতে অবিলম্বে পরিবারগুলোর অবদান স্বরূপ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি।
এবিএ/ ০১ জানুয়ারি