সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি;: অতিথি পাখি, মাছ ও জীববৈচিত্র্যের কারণেই সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাংগুয়ারকে রামসার সাইট (রামসার কনভেনশন কর্তৃক আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত জলাভূমি) ঘোষণার পর এ হাওরের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। কিন্তু সেই বিশ্ব ঐতিহ্য স্বীকৃত হাওরের পরিযায়ী পাখিসহ বন্যপ্রাণী রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন হুমকির মুখে পড়েছে। এজন্য স্থানীয় পাখি, মাছ শিকারি ও যত্রতত্র গাছ কাটার কারণে হাওরের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া ও অতিথি পাখি কমে যাওয়াকে দায়ি করছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৯৯১ সালে ইরানের রামসার নগরে অনুষ্টিত বিশ্বের নেতৃস্থানীয় সম্মেলনে গৃহিত রামসার কনভেনশন অনুযায়ী টাংগুয়ার হাওরকে রামসার সাইট ঘোষণার পর সরকারের সুনজর পড়ে জীব বৈচিত্র সমৃদ্ধ মিঠা পানির এই হাওরের বিপুল সম্পদের দিকে। এরপর ২০০০ সালের ১০ জুলাই মাসে এ হাওরকে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনেসকো এক হাজার ৩১তম রামসার সাইট ঘোষণা করে।
২০০৫ সালে জেলা প্রশাসক ও আর্ন্তজাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) যৌথভাবে হাওরের দায়িত্ব নিলেও কোনো সুফল আনতে পারেনি। বরং টাংগুয়ার হাওরের সৌন্দর্য, সম্পদ ধ্বংস হয়েছে বলে জানান হাওর পাড়ের বাসিন্দারা।
টাংগুয়ার হাওর পাড়ের বাসিন্দা নিরব আহমেদসহ অনেকেই জানান, এক সময় হাওরে মাছ, গাছ, পাখি, জীববৈচিত্র্য পরিপূর্ণ ছিল। প্রতি বছর শীত শুরুর আগে থেকেই সুদূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, নেপালসহ শীত প্রধান দেশ থেকে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসে টাংগুয়ার হাওরসহ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে নিরাপদ আশ্রয় ও খাদ্যের আশায়। এ সময় পাখির কলতানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো হাওর এলাকা। এমনকি শীতকালে প্রচুর দেশি পর্যটকের সঙ্গে বিদেশি পর্যটক আসেন এই পাখি দেখার জন্য। কিন্তু এখন আর পরিবেশ আগের মতো নেই। হাওরটি দিন দিন জৌলুস হাড়াচ্ছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ছোট-বড় ১২০টি বিল আছে এ হাওরে। ৪৬ গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার, এর মধ্যে দুই লাখ ৮০ হাজার ২৩৬ হেক্টর জলাভূমি। প্রতি বছর এ হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির সমাগম ঘটে। এছাড়াও হাওরে প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবাস। সুন্দরবনের পরেই টাংগুয়ার হাওরের অবস্থান।
বীর মুক্তিযুদ্ধা নুরুল ইসলাম বাঘা জানান, রামসার সাইট টাংগুয়ার হাওর পরিযায়ী পাখি ও মাছের আভাসস্থল। এ হাওরের সুনাম হলো পরিযায়ী পাখি। বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ এ কারণে টাংগুয়ার হাওরকে চেনে। তবে আগের মতো আর পাখি আসছে না। স্থানীয় সংঘবদ্ধ পাখি শিকারীদের কারণে এখন হুমকির মুখে পড়েছে এই প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই প্রশাসনের কঠোর নজরধারী বাড়ানো উচিত।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট ঢাকার পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল সাদিক সম্প্রতি সুনামগঞ্জে এক সভায় বক্তব্যে জানান, বিশ্ব ঐতিহ্য স্বীকৃত এই টাংগুয়ার হাওরের পরিযায়ী পাখিসহ বন্যপ্রাণী এখন হুমকিতে পড়েছে। অতিথি পাখি না এলে হাওরের তলদেশ শেওলায় ভরে যাবে। পানিতে অক্সিজেন থাকবে না। পাখি না এলে মাছের পুষ্টিকর খাদ্য, পাখির মলের অভাবে মাছ পুষ্টিকর হবে না।
যেখানে প্রতি বছর শীতে লক্ষাধিক অতিথি পাখি আসত গত বছর মাত্র ২৫ হাজার অতিথি পাখি এসেছে। পাখি নিধন বন্ধ করতে না পারায় এই পাখি আসা ২০ হাজারের নিচে নেমে গেলে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনেসকো রামসার সাইট থেকে টাংগুয়ার নাম কেটে দেবে। এতে টাংগুয়ার নাম বিশ্ব ঐতিহ্য থেকে মুছে যাবে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রায়হান কবির বলেন, টাংগুয়ার হাওরে অসাধু পাখি শিকারিদের ছাড় দেওয়া হবে না। কঠোরভাবে ধমন করা হবে। শুধু পাখিই না, হাওরের কোনো কিছুই যাতে অসাধু চক্রের হাতে না পড়ে, সেজন্য প্রশাসন কঠোর ভূমিকা রাখছে। আর পরিযায়ী পাখি নিধন বন্ধে সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে।
এবিএ/ ১ ডিসেম্বর