অজয় বৈদ্য অন্তর:: সিলেট বিভাগের চারটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন পাঁচ নারী। তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করছেন তিনজন। অপর দু’জন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী।এদের মধ্যে একজন বর্তমান চেয়ারম্যান। তিনি গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি-ই ছিলেন সিলেট বিভাগের একমাত্র নারী ইউপি চেয়ারম্যান। অন্য চারজনের মধ্যে একজন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করলেও অন্য তিনজন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ভোটে নেমেছেন। পুরুষ প্রার্থীদের সঙ্গে ভোটযুদ্ধ করছেন, ভোটে জিততে দিন-রাত প্রচারণা চালাচ্ছেন। ভোটারদের ঘরে ঘরে, দুয়ারে দুয়ারে ছুটছেন। তাদের পক্ষে প্রচারণায় মাঠে নেমেছেন তাদের সমর্থক নারীরাও।এই পাঁচ নারী চেয়ারম্যান প্রার্থী হলেন নার্গিস আক্তার বুবলি, সুলতানা কোহিনুর সারোয়ারী, মোছা. ছালমা আক্তার চৌধুরী, মোছা. চম্পা বেগম ও রোকশানা আক্তার শিখা।
নার্গিস আক্তার বুবলি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান। তিনি গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়ে চমক দেখান। ওই নির্বাচনে তাঁর প্রাপ্ত ভোট ছিল ২১৮৯। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগপ্রার্থী লুৎফুর রহমান চৌধুরী (নৌকা) পান ১৯৯৩ ভোট। এবার তিনি দলের কাছে মনোনয়নই চাননি। আনারস প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।তিনি কুলাউড়ায় ভোটের মাঠে একমাত্র নারী চেয়ারম্যান প্রার্থী। তার প্রচার-প্রচারণায় নেমেছেন গৃহিণীরাও। তাঁর সমর্থক নারীরা দল বেধে ভোটার ঘরে ঘরে আনারস প্রতীকের লিফলেট নিয়ে যাচ্ছেন। নারী ভোটারদের মন জয় করে সমর্থন আদায়ে সবরকম কসরত করছেন। ভোটের খেলায় অভিজ্ঞ এই নারী প্রার্থীও বসে নেই।গণসংযোগ, প্রচার-প্রচারণা ও উঠোন বৈঠক সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন। তার নির্বাচনী কৌশল উপভোগ করছেন সাধারণ ভোটাররা।
নার্গিস আক্তার বুবলী বলেন, গেলবারের মতো এবারও ভোটারদের চাপে ফের ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। ভোটারদের প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। আশা করছি-ইউনিয়নের উন্নয়নের স্বার্থে এলাকাবাসী আমাকে তাদের মূল্যবান ভোট প্রয়োগ কের বিজয়ী করবেন।
এই ইউনিয়নে আওয়ামীলীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী হলেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাবেক আহবায়ক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোছাদ্দিক আহমদ নোমান নৌকা। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে উপজেলা যুবদলের আহবায়ক জুবের আহমদ খান (চশমা) ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী (মোটরসাইকেল) ভোটের মাঠে রয়েছেন।
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সুলতানা কোহিনুর সারোয়ারী নামে আরেক নারী।তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। নির্বাচনে তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা না থাকলেও এ উপজেলার একমাত্র নারী প্রার্থী সারোয়ারী ভোটযুদ্ধে পুরুষপ্রার্থীদের সঙ্গে সমানতালে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।ইতোমধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উঠে এসেছেন তিনি।তাকে ঘিরে কৌতুহল রয়েছে ভোটারদের।নির্বাচনে চমক দেখাতে পারেন বলে মনে করছেন তাঁর সমর্থক ভোটাররা।
এ ইউনিয়নে সারোয়ারীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আজির উদ্দিন (ঘোড়া)।
সুনামগঞ্জ জেলা সদরের গৌরারং ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দুই নারী প্রার্থী। এদের একজন জেলা কৃষক লীগের সদস্য এবং জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোছা. ছালমা আক্তার চৌধুরী।আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীকে লড়ছেন তিনি। অপরজন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মোছা. চম্পা বেগম।আওয়ামী লীগের কর্মী হিসাবে দলের মনোনয়ন দাবিও করেছিলেন তিনি। দলের তৃণমূল থেকে তার নামও গিয়েছিল কেন্দ্রে। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে চশমা প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হয়েছেন তিনি।
প্রতীক হাতে পাওয়ার পর থেকে এই দুই নারী চেয়ারম্যার প্রার্থীর ফুসরত মিলছে না।প্রতীক সম্বলিত লিফলেট নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ছুটছেন।ভোট প্রার্থনা করছেন।
এই দুই প্রার্থীর বদান্যতায় ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত হয়েছেন গৃহিণীরাও। ভোটারদের মধ্যেও তাদের ঘিরে আগ্রহ রয়েছে।ভিন্ন আমেজ পরিলক্ষিত হচ্ছে ভোটে।তাদের সমর্থক নারী ভোটাররা প্রচারণায় নামায় সুনামগঞ্জ জেলা শহরসহ আশপাশ এলাকায় এই ইউনিয়নের নির্বাচন নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে।
ইউনিয়নের ভাটি সাফেলার মল্লিকা বেগম বললেন, ‘গৌরারং ইউনিয়নে এর আগে কখনো চেয়ারম্যান প্রার্থী হয় নি কোনো নারী। এবার একজন নয়, দুজন প্রার্থী হয়েছেন। তাদের প্রচারণায় আমরা থাকছি সানন্দে। নারীরা মনে করছেন, তাদের উৎসাহ না দিলে, আর কোন দিন কেউ এভাবে সাহস করবে না।’
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউপিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত মহিলা প্রার্থী সালমা আক্তার বলেন, প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। জনগণের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। নারী প্রার্থীদের এমন গুরত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে-এমনটি ভাবাও যেতো না। তিনি বলেন, গণসংযোগ কালে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই নৌকা প্রতীকের বিজয়ের লক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। একই ইউপিতে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন আরো এক নারী প্রার্থী। তিনি সুনামগঞ্জ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য চম্পা বেগম। নিজ প্রার্থীতা বিষয়ে তিনি বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে মানুষ দলীয় প্রতিকে নয়, ভোট দেয় প্রার্থী যোগ্যতা দেখে। সে হিসেবে ইউনিয়নবাসী তাদের প্রত্যাশা পূরণে আমাকে নির্বাচনে বিজয়ী করবেন বলে প্রত্যাশা করছি।
হবিগঞ্জজেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন রোকসানা আক্তার শিখা। গত ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ভোটগ্রহণকালে গোলযোগের কারণে এ ইউপির নির্বাচন স্থগিত করা হয়। সামান্য ভোটে এগিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ প্রার্থী রোকসানা আক্তার শিখার প্রতীক ছিল নৌকা। এ ইউপির স্থগিত হওয়া ভোট কবে হবে-তা নির্ধারণ করেনি নির্বাচন কমিশন।
এ ইউনিয়ন পরিষদে ভোটযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন প্রার্থী। এদের মধ্যে জেলার একমাত্র নারীপ্রার্থী রোকসানা আক্তার শিখা। স্থানীয়রা বলছেন, ২০১৪ সালে বিএনপি সমর্থীত ১৯ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। তবে, রোকসানা আক্তার এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমি সব সময়ই আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলাম।’
এ ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ স্থগিত হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আজমিরীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মনোয়ার আলী। তিনি বলেন, যে প্রার্থী ও তার সমর্থকরা ভোট কেন্দ্রে সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে, ব্যালেট পেপার পুড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার; যাতে ভবিষ্যতে এ ধরণের অপরাধ করতে কেউ আর সাহস করতে না পারে। তিনি বলেন, আমরা দলীয় নেতাকর্মীরা দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনোনীত নৌকা প্রতীকের বিজয় নিশ্চিতে আমরা কাজ করেছি। আগামীতেও বিজয় নিশ্চিতে মাঠে থাকব।
উল্লেখ্য, গত ১০ অক্টোবর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার তিন নম্বর জলসুখা ইউনিয়নে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. শাহজাহান মিয়াকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। এর ছয় দিনের মাথায় ১৬ অক্টোবর তাকে পরিবর্তন করে সাবেক নারী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রোকসানা আক্তারকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ।এতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ভোটে নামেন আওয়ামী লীগ নেতা মো. শাহজাহান মিয়া।
এবিএ/২৩ নভেম্বর