সিলেট৭১নিউজ ডেস্ক::তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পরপরই সবচেয়ে বড় হামলাটি চালায় আইএস। এতে কমপক্ষে ১৭৫ জন বেসামরিক ও ১৩ মার্কিন সেনা নিহত হয়। এই আইএস মূলত খোরাসান প্রদেশভিত্তিক। আইএসকেপি বা আইএসআইএস-কে বলে পরিচিত এই জঙ্গি সংগঠন।
সর্বশেষ শুক্রবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর কুন্দুজের একটি মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় কমপক্ষে অর্ধশত মানুষ নিহত হয়েছেন। এটি মূলত শিয়া অধ্যুষিত এলাকা। হামলার কয়েক ঘণ্টা পর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে আইএস খোরাসান।
ইরাক, সিরিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলে ব্যাপক রক্তপাতের পর পর্যুদস্ত হয়ে এখন আফগানিস্তানের এই ক্রান্তিকালে কেন এই নৃশংস জঙ্গি সংগঠনটি মরিয়া হয়ে উঠেছে? তালেবানের মতো সংগঠিত ও শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকার পরও এখানে কী অর্জন করতে চায় তারা? আর কীভাবেই-বা তারা খোরাসানের বাইরেও এত বড় হামলা পরিচালনা করতে পারছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে খোরাসানভিত্তিক আইএসের একটু সুলুক সন্ধান করা যাক।
মধ্যপ্রাচ্যের আইএসআইএস (বা আইএসআইএল) গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি গোষ্ঠীই এই আইএস-কেপি। ২০১৪ সালে পাকিস্তানি তালেবান ও আফগান তালেবানের একটি অংশই এটি প্রতিষ্ঠা করে। তারা ওই সময় আইএসআইএল প্রতিষ্ঠাতা আবু বকর আল বাগদাদির আনুগত্য ঘোষণা করে। এরা একটি ক্ষুদ্র, নতুন এবং তালেবানের চেয়ে সহিংস মতাদর্শে বিশ্বাসী গোষ্ঠী।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আইএস-কেপি আন্তর্জাতিক সীমানা মানে না। তারা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। খোরাসান নামের মধ্যেই তাদের আদর্শের কিছুটা প্রতিফলন রয়েছে। খোরাসান মানেই ‘দ্য ল্যান্ড অব দ্য সান’। খোরাসানের ঐতিহাসিক মানচিত্রে রয়েছে ইরান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও পাকিস্তানের অংশ। এই অঞ্চল এক সময় এক খিলাফতের অধীনে ছিল।
এই আইএসের উৎপত্তি কোথায়
মূলত আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীকে উৎখাতের জন্য যেসব গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল, এরাও তাদের মধ্যে একটি। এই গোষ্ঠীগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে আফগানিস্তানের মাটিতে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কিছুটা শত্রুতাও আছে তাদের মধ্যে।
নাইন-ইলেভেন হামলার পর তৎকালীন বুশ প্রশাসন জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটনের ঘোষণা দেয়। আফগানিস্তানে আশ্রিত আল-কায়েদাকে ধ্বংস করতে সামরিক অভিযান শুরু হলে তালেবান সরকারও উৎখাত হয়। এর পর আল-কায়েদার একটি অংশ আলাদা হয়ে যায়। তারা ইরাক ও সিরিয়ার একটি বড় অংশজুড়ে খিলাফত ঘোষণা করে। এই ভূখণ্ডের আকার ব্রিটেনের সমান। এই অংশটিই পরে ইসলামিক স্টেট বা আইএস বা আইএসআইএস বা আইএসআইএল নামে পরিচিত হয়। সামাজিক মাধ্যমে তারা আল-কায়েদার চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। এরা নাটকীয়ভাবে সিনেমার মতো করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলে। এটিই তাদের কৌশল। এদের প্রচারের কৌশল আধুনিক ও আগ্রাসী। প্রধান লক্ষ্য তরুণ সমাজ। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণীকে সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিতে দেখা গেছে।
২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় আইএস থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, খোরাসান অঞ্চলে সক্রিয় গোষ্ঠী তাদের কাছে বায়াত (শপথ নিয়ে আনুগত্য ঘোষণা) নিয়েছে।
তবে ২০১৪ সালে মিডল ইস্ট ফোরামের ফেলো আইমান জাওয়াদ আল তামিমি আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আইএস খোরাসান আসলে কোনো আলাদা বিচ্ছিন্ন গ্রুপ নয়। বরং আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্ত থেকে আসা আল-কায়েদা সদস্যদের নিয়েই গঠিত হয় এই গ্রুপ।
তাদের প্রধান শত্রু কারা?
আইএস-কেপি গ্রুপের প্রধান শত্রু মার্কিন বাহিনী। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও বেসামরিক নাগরিক। তবে অন্যান্য ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের পার্থক্য হচ্ছে, তারা তালেবানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যদিও উভয়েই সুন্নি মুসলিম।
আফগানিস্তানের মাটিতে আইএস-কেপি কোনোভাবেই তালেবানকে ছাড় দিতে রাজি নয়। বিশেষ করে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব মারাত্মক পর্যায়ে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ২০১৭ সাল থেকে মার্কিন, আফগান ও পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে প্রায় ২৫০বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে এই আইএস।
খুব সম্ভবত আইএস-কেপি নেতারা বর্তমান তালেবানের আফগানিস্তানের ক্ষমতাগ্রহণকে সহ্য করছেন না। তাদের মতে, তালেবানের বর্তমান ইসলাম তাদের মতো যথেষ্ট শুদ্ধ নয়।
দোহায় তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যখন শান্তি আলোচনা শুরু হয়, তখন এই আইএসের পক্ষ থেকে তীব্র আপত্তি আসে। তারা বরাবরই এই শান্তি প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে এসেছে।
তাহলে কি আইএস শেষ হয়ে যায়নি?
২০১৯ সালের অক্টোবরে আবু বকর আল বাগদাদি নিহত হওয়ার খবর জানান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট জোর গলায় বলেন, আমরা তাঁর খিলাফত উৎখাত করেছি। এই বছরের মার্চেই শতভাগ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে আবারও আইএসআইএস এবং এর আঞ্চলিক খিলাফত ১০০ ভাগ ধ্বংসের কথা বলেন ট্রাম্প। তিনি আরও বলেন, বাগদাদি নিহত হওয়ার আগে নাকি নতুন করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে।
২০১৭ সালের এপ্রিলে একটি মার্কিন কার্গো বিমান থেকে ২০ হাজার পাউন্ড বোমা ফেলা হয়। এই সময় ‘মাদার অব অল বম্ব’ নামের ওই বোমা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, আচিন জেলায় পাহাড়ের গুহায় আইএস খোরাসানের একটি গোপন আস্তানায় মার্কিন অস্ত্রাগারের বৃহত্তম এ বোমা ফেলা হয়েছে।
অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবেই দাবি করার চেষ্টা করেছে, তারা মধ্যপ্রাচ্যের আইএস তো বটেই বিভিন্ন অঞ্চলে এর প্রতি অনুগত গোষ্ঠীগুলোরও কোমর ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু এখন একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, ১০০ ভাগ নিশ্চিহ্ন করার যে দাবি ট্রাম্প করেছিলেন, সেটি আসলে বাগাড়ম্বর।
বাগদাদি নিহত হওয়ার আগে তাঁর সংগঠনকে বিস্তৃত করেছেন। বিভিন্ন অঞ্চলে অনুগত ছোট ছোট গ্রুপ রেখে গেছেন তিনি। আইএসআইএস ইরাক সিরিয়ার বাইরে একা বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপে হামলা করাকেই সব সময় উৎসাহিত করে এসেছে। চরমপন্থী সংগঠন বিষয়ে জর্ডানের বিশেষজ্ঞ হাসান আবু হানিয়ে বলেন, নেতাকে হত্যা করা মানেই কিন্তু সংগঠনের বিনাশ নয়। তিনি বলেন, আইএস এমন একটি নতুন কাঠামো তৈরি করেছে, যেটি আগের মতো কেন্দ্রীভূত নয়। বাগদাদিকে ছাড়াই তারা চলতে পারবে।
আইএস খোরাসান প্রতিষ্ঠার পর ২০১৬ সালে এই সংগঠনের আকার ছিল সবচেয়ে বড়। তাদের যোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার। তবে মার্কিন বিমান হামলা এবং আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানের ফলে পরে সেই সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে।
কী চায় আইএস খোরাসান
এখন প্রশ্ন হলো এত কম জনবল ও অস্ত্র নিয়ে আফগানিস্তানে আসলে কী অর্জন করতে চায় আইএস খোরাসান?
গত আগস্টে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে পেন্টাগনের মুখপাত্র দাবি করেন, বাগরামে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কারাগার থেকে হাজার হাজার আইএস যোদ্ধাকে মুক্ত করে দিয়েছে তালেবান।
যদিও তালেবানের সঙ্গে তাদের কোনো সমঝোতার খবর কোথাও পাওয়া যায়নি।
বারবার হামলার পেছনে উদ্দেশ্য সম্পর্কে থিংক ট্যাংক নিউলাইনস ইনস্টিটিউটের প্রধান রাশা আল আকিদি বলেন, আইএস খোরাসান সংগঠনের প্রচারণার অংশ হিসেবেই হামলা চালিয়ে যাবে।
আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আইএস খোরাসান বা সাধারণভাবে আইএসআইএল যেখানেই সক্রিয় থাকুক না কেন, তাদের হামলার পেছনে কোনো তাৎক্ষণিক লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্য নেই। তাদের এ ধরনের হামলা চালানোর পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য থাকে, যত বেশি সম্ভব রক্তপাত ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো। এর মাধ্যমে তারা অস্তিত্ব জানান দিতে চায়। তারা বার্তা দিতে চায় যে, আইএস এখনো ফুরিয়ে যায়নি এবং আইএস এখনো বিবেচনাযোগ্য হুমকি। এ ক্ষেত্রে ইরাক ও সিরিয়াতে আইএসআইএলের সঙ্গে আইএস খোরাসানের কৌশলের কোনো পার্থক্য নেই।