সিলেট৭১নিউজ ডেস্ক::অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী উম্মে ফাতেমা রোজী (৩৫)। বাড়ি ঝালকাঠিতে। দেখতে সুন্দরী। কথা বলেন ইংরেজি-বাংলায়। মিষ্টি কণ্ঠে কথা বলে যে কাউকে মুগ্ধ করতে পারেন। পরিচয় দেন অস্ট্রেলিয়া ইমিগ্রেশন কনস্যুলার জেনারেল হিসেবে। ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের কাছ থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন বলে ছবি দেখান। অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রেশনমন্ত্রী এলেক্স হাউকির সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে বলেও প্রচার করেন।
কিন্তু তার এসব প্রচারণার পেছনে কাজ করে ভিন্ন উদ্দেশ্য। কারণ তিনি অস্ট্রেলিয়ায় বসে বাংলাদেশে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার ব্যক্তির সঙ্গে অনলাইনে মিথ্যা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তারপর তাদের পরিবারসহ অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে স্থায়ী করার প্রলোভন দেখান। ভালো চাকরি পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন। বিশ্বাস করার জন্য ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ভিসার আবেদন করান। কিন্তু বাস্তবে কারও কোনো ভিসা করাতে বা অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে পারেননি। বরং উল্টো ওইসব ব্যক্তির কাছ থেকে বিভিন্ন কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন। গত কয়েক বছরে অস্ট্রেলিয়া বসে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অসংখ্য ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। তার প্রতারণা থেকে রেহাই পাননি সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। পরিবারের আট সদস্যসহ অস্ট্রেলিয়ায় যেতে চেয়েছিলেন তিনি। এজন্য তিনি রোজীকে ৭৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তার পরিবার নিয়ে আর অস্ট্রেলিয়া যেতে পারেননি।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা হলো- মো. সাইমুন ইসলাম (২৬) ও আশফাকুজ্জামান খন্দকার (২৬)। এই দুজন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী উম্মে ফাতেমা রোজীর সহযোগী। খিলগাঁও থানার একটি মামলায় ঢাকার বনশ্রী এবং শাজাহানপুর থেকে সিআইডির ঢাকা মেট্রো পূর্বের একটি টিম তাদেরকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে অস্ট্রেলিয়া থাকায় এই প্রতারণার মূলহোতা উম্মে ফাতেমা রোজীকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তাকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে সিআইডি।
সিআইডি’র অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, উম্মে ফাতেমা রোজী বাংলাদেশি পুরুষদের টার্গেট করে অনলাইনে প্রেমের ফাঁদে ফেলেন। এরপর দেশে এসে আস্থা অর্জন করেন। দেশে এসে টার্গেট করে অনেক পরিবারের সঙ্গে নিজে থেকে সখ্যতা বাড়ান। তাদেরকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখান। প্রস্তাব দেন একা গেলে ১৮ লাখ। আর সস্ত্রীক গেলে ২৩ লাখ। প্রস্তাবে রাজি হলে শুরু হয় প্রতারণা। রোজী অস্ট্রেলিয়া থাকলে প্রতারণার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে তার সহযোগীরা বিভিন্ন ব্যক্তিদের নাম ঠিকানা, পেশার তথ্য তার কাছে পাঠাতো। পরিচয়ের পর সখ্যতা একপর্যায়ে মিথ্যা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে টার্গেটকৃত ব্যক্তির জাল ভিসা ও টিকিট বানিয়ে গাঢাকা দেয় প্রথমে রোজীর সহযোগীরা। তখন পর্যন্ত ভুক্তভোগী বুঝতে পারেন না তিনি ফাঁদে পড়ছেন। বুঝে ওঠার আগেই রোজী বিভিন্ন কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা তার হেফাজতে নিয়ে যেতো। আর ভুক্তভোগী অ্যাম্বাসিতে গিয়ে যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে বুঝতে পারেন তার কাগজপত্র ও আবেদন পুরোটাই ভুয়া। আর পরবর্তীতে রোজী বা তার সহযোগীদের গাঢাকা দেয়ার বিষয় থেকেই নিশ্চিত হন তিনি ফাঁদে পড়েছেন।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ৪৭ বছর বয়সী এক আইনজীবী রোজীর ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। তার পরিবারের আট সদস্যসহ অস্ট্রেলিয়ায় যেতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৭৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা রোজীর অ্যাকাউন্টে দেন। এরপর কাগজপত্র ও ভিসা হাতে পেয়ে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখতে পান সবগুলোই ভুয়া এবং জাল। পরে তিনি খিলগাঁও থানায় মামলা করেন রোজীর বিরুদ্ধে। এরপরই সামনে আসে তার প্রতারণার ঘটনা।
সিআইডি সূত্র জানায় পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে আইনজীবীর করা মামলার তদন্ত শুরু করে সিআইডি। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সিআইডি জানতে পারে, দীর্ঘদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ান রিলেটিভ স্পন্সর মাইগ্রেশন সাবক্লাস (৮৩৫) পার্মান্যান্ট রেসিডেন্স জাল ভিসা প্রস্তুত করে বাংলাদেশের নিরীহ লোকজনদের অস্ট্রেলিয়াতে পাঠানোর নাম করে প্রতারণা করে আসছিল একটি চক্র। পরে চক্রের সদস্য সাইমুন ও আশফাকুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তাদের মূল হোতা উম্মে ফাতেমা রোজী। তার অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট নম্বর চঅ ৯৭৪০৩১২। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। রোজী অস্ট্রেলিয়া বসে অনলাইনে অনেকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করতেন। পরে তাদেরকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিতেন। দেশে থাকাকালীন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম এ বি এম খায়রুল ইসলামকে (৪৭), অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন মিথ্যা পরিচয় দেন। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য আইনজীবীকে জানান, তিনি অস্ট্রেলিয়া ইমিগ্রেশন কনস্যুলার জেনারেল। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের কাছ থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রেশনমন্ত্রী এলেক্স হাউকির সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। এসব মিথ্যা পরিচয় দেন রোজী আরও অনেককে। এসব কারণে তার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ে। রোজী তার নিজ অ্যাকাউন্টে ৮ হাজার কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলার রয়েছে বলে জাল ব্যাংক স্ট্রেটমেন্ট আইনজীবীর ই-মেইলে পাঠান। অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রেশন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আইনজীবীর পরিবারকে ভিসা পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন। তার এসব কথা শুনে ও প্রস্তাবে রাজি হয়ে নিজেসহ তার পরিবারে আরও আটজন সদস্যকে অস্টেলিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রথমে ৭৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। এরপর রোজীর অন্যতম সহযোগী মো. সাইমুন ইসলাম ও মো. আশফাকুজ্জামান খন্দকার অস্ট্রেলিয়ান অ্যাম্বাসির নিযুক্ত ভিএফএস গ্লোবাল বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের প্রতিনিধির মিথ্যা পরিচয় দিয়ে, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়া অ্যাম্বাসির লোগোসহ ভিসা সংক্রান্ত সকল প্রকার কাগজ রোজীর মেইলে পাঠায়। পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ান অ্যাম্বাসির জাল ডকুমেন্ট আইনজীবীর মেইলে পাঠিয়ে জমা দিতে বলে। আইনজীবী ভিফিএস গ্লোবাল বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড অফিসে কাগজপত্র জমা দিতে গেলে সেখান থেকে বলা হয় সকল কাগজপত্র জাল।
সিআইডি জানিয়েছে, যে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে জাল ভিসা প্রস্তুত কাজে ব্যবহৃত একটি কম্পিউটার, অস্ট্রেলিয়ার জাল ভিসা গ্রান্ট নোটিশ সাতটি, ফ্রি চিকিৎসার হেলথ মেডিকেয়ার কার্ড ৫টি ও অস্ট্রেলিয়ার বিমানের টিকিট ৬টি জব্দ করা হয়।
সুত্রঃ দৈনিক মানবজমিন