ডেস্ক: গুলশানে কলেজ ছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়া নিহতের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। গত সোমবার সন্ধ্যায় গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাট থেকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া বাদী হয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করেন। পরদিন মঙ্গলবার ময়নাতদন্ত শেষে কুমিল্লায় মা-বাবার কবরের পাশে মুনিয়ার লাশ দাফন করা হয়। গতকাল বুধবার ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ কেন্দ্রীয় কমিটি মুনিয়ার মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে।
এদিকে, সায়েম সোবহান আনভীর-এর দেশত্যাগে আদালত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু মামলার দু’দিন পরও তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় হাইকোর্টে আগাম জামিন আবেদন করেছেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর। গতকাল বুধবার মামলাটি হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ১৪ নম্বর ক্রমিকে রাখা হয়েছে। এর ফলে আজ বৃহস্পতিবার জামিন আবেদনের ওপর বিচারপতি মামুনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি হবে।
মামলার এজাহারে নিহতের বড় বোন নুশরাত জাহান অভিযোগ করেছেন, সায়েম সোবহান আনভীরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল মুনিয়ার। প্রতিমাসে এক লাখ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে সায়েম সোবহান মুনিয়াকে ওই ফ্ল্যাটে রেখেছিল। আনভীর নিয়মিত ওই বাসায় যাতায়াত করতো। তারা স্বামী-স্ত্রীর মতো করে থাকতো। মুনিয়ার বোন অভিযোগ করেছেন, তার বোনকে বিয়ের কথা বলে ওই ফ্ল্যাটে রেখেছিল। একটি ছবি ফেসবুকে দেওয়াকে কেন্দ্র করে সায়েম সোবহান তার বোনের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। তাদের মনে হচ্ছে, মুনিয়া আত্মহত্যা করেনি। তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। গুলশান অঞ্চলের উপ-পুলিশ কমিশনার বলেছেন, এ অভিযোগের ব্যাপারে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে পুলিশ।
বসুন্ধরার এই কর্মকর্তা দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে সামাজিক মাধ্যমে খবর ছড়িয়েছে পড়লেও পুলিশ বলছে, তাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী তিনি দেশের ভেতরেই রয়েছেন। আর মৃত তরুণীর পরিবার জানিয়েছে, মামলা করার পর থেকে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে ঢাকার গুলশান অঞ্চলের উপ-পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক সাক্ষ্য, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বা বস্তুগত সাক্ষ্য- সকল বিষয়কে আমাদের গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ভিকটিমের মোবাইল ফোন, সেখান থেকে তথ্য উদ্ধারের চেষ্টার পাশাপাশি অন্যান্যভাবেও তাদের মধ্যে বিভিন্নভাবে সম্পর্কের যে অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে, তার যৌক্তিকতা, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে, সেই ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সংশ্লিষ্টতা, সেগুলো আমাদের বেশ গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যখন পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ আমাদের কাছে আসবে, তখন দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া হবে।’
এর আগে মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘ওই তরুণীর মৃহদেহ উদ্ধারের পর সেখান থেকে তার মোবাইলসহ বিভিন্ন ধরনের আলামত উদ্ধারের সাথে ৬টি ডায়েরি পাওয়া যায়। এসব ডায়েরিতে কী লেখা আছে, তা যাচাই করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ওই ফ্ল্যাটে তরুণীর একা থাকার কথা বলা হলেও কে কে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকত, সে জন্য ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ডায়েরির সাথে সেগুলো যাচাই চলছে।’
বসুন্ধরার বক্তব্য
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে বসুন্ধরা গ্রুপের গণমাধ্যম বিষয়ক উপদেষ্টা মোঃ আবু তৈয়ব একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যেহেতু এই বিষয়ে মামলা হয়েছে, তারা আইনগতভাবেই এগোবেন। তিনি আরও বলেন, ‘এই মামলা করা এবং পুরো ঘটনাকে তারা বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসাবে দেখছেন।’
আইনি সহায়তার ঘোষণা ব্যারিস্টার সুমনের কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তার পরিবারকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। গতকাল বুধবার ব্যারিস্টার সুমন গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘মুনিয়ার বাবা-মা কেউ পৃথিবীতে নেই। এই এতিম মেয়ের জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যদি ভালো আইনজীবী না পান তাহলে আমি মুনিয়ার পক্ষে দাঁড়াতে চাই। তার পরিবারকে আমি আইনি সহায়তা দিতে চাই।’ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি প্রত্যাশা ব্যক্ত করে ব্যারিস্টার সুমন বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটাই আবেদন রাখবো, আপনি তো শক্তিশালী যুদ্ধাপরাধীদেরও ৩০/৩৫ বছর পরে হলেও বিচারের মুখোমুখি করেছেন। তাই আমার বিশ্বাস জনগণের যে প্রত্যাশা আপনার ওপর, বসুন্ধরা হোক বা যে শিল্প প্রতিষ্ঠানই হোক না কেন, তাদের যেকোনও ধরনের অপরাধ আপনি যতদিন নেতা হিসেবে থাকবেন, নিশ্চয়ই তাদের বিচার এই মাটিতে হবে। সুষ্ঠু বিচার হবে এবং জনগণের সামনে এটা প্রমাণিত হবে যে আপনি কোনও কিছুতেই পিছপা হননি। সে যে-ই হোক না কেন।’ একইসঙ্গে দল-মত নির্বিশেষে এই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
মুনিয়ার মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি
মোসারাত জাহান মুনিয়া মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ কেন্দ্রীয় কমিটি। গতকাল বুধবার সংগঠনটির সভাপতি মো. সাজ্জাদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান শাহীন এক বিবৃতিতে এই দাবি জানান।
বিবৃতিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মুনিয়ার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘মুনিয়ার এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। ‘এটা হত্যা না আত্মহত্যা, এ নিয়ে সঠিক তদন্ত প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। তাই এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর সঠিক বিচারের স্বার্থে এবং মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।’
তারা আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার আইনের শাসনে বিশ্বাস করে। এই দেশকে স্বাধীন করতে মুনিয়ার বাবার অসামান্য অবদানের কথা বিবেচনায় নিয়ে এবং আইনের শাসন সমুন্নত রাখার স্বার্থে আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার দাবি করছি।’
দায়ীদের আইনের মুখোমুখি হতে হবে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় কারও অপরাধ থেকে থাকলে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। গতকাল বুধবার রাজধানীতে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ে কথা বলেন তিনি। সোমবার রাতে ঢাকার গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় ২১ বছর বয়সী মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে তার বোন ইসরাত জাহান তানিয়া গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন, যেখানে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে ‘আত্মহত্যায় প্ররোচণার’ অভিযোগ আনা হয়।
মামলায় বলা হয়েছে, ওই তরুণীর সঙ্গে ‘প্রেমের সম্পর্ক’ ছিল আনভীরের; গুলশানের ওই ফ্ল্যাটে তার যাতায়াতও ছিল।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আইন অনুযায়ী সবকিছু চলবে। যে অপরাধী হয়, তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে, বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
তবে বিষয়টি যেহেতু তদন্তাধীন, তা শেষ হলেই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে বলে মন্তব্য করেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। উল্লেখ্য, মুনিয়া ঢাকার একটি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি কুমিল্লায়। পরিবার সেখানেই থাকে। তিনি ঢাকায় একাই থাকতেন গুলশানের ওই ফ্ল্যাটে।