সিলেট৭১নিউজ:: বাড়ছে করোনা আক্রান্ত (কোভিড-১৯) রোগীর সংখ্যা। একইসঙ্গে বাড়ছে করোনায় মৃত্যুও। কোভিড সংক্রমণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেখানে কোনো তদবিরেও মিলছে না মরণাপন্ন রোগীর জন্যে একটি আইসিইউ বেড। দুঃখজনক মৃত্যুতেই কেবল খালি হতে পারে আইসিইউ। এই ভরসাতেও অপেক্ষা করতে হয় অনেক এইচডিইউ’র রোগীদের। দেশের কিংবদন্তী অভিনেত্রী নায়িকা সারাহ বেগম কবরীর ৫ এপ্রিল করোনাভাইরাস পজেটিভ ধরা পড়ে। সেদিন রাতেই তাকে রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
গত বুধবার রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় আইসিইউতে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে।
কিন্তু কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ বেড পাননি। অতপর সাবেক এমপি কবরীর অবস্থার অবনতি হলে তার ব্যক্তিগত সহকারী নুর উদ্দিন রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করাতে পারেনি। অতপর তিনি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে বিষয়টি জানান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কবরীকে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। নায়িকা কবরীর ভাগ্য ভালো প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে যথাসময়ে আইসিইউ পেয়েছেন।
একজন ডাক্তারের ভাইকে আসগর আলী হাসপাতালে শিফট করায় সেই আইসিইউ কবরী সরোয়ার পেয়েছেন, বলছিলেন হাসপাতালের এক চিকিৎসাকর্মী। এভাবেই অনেক ভিভিআইপিকে সর্বোচ্চ তদবির করে পেতে হয় একটি আইসিইউ বেড। রাজধানীর শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে আইসিইউ এর খোঁজ নিতে গেলে জানানো হলো ‘হাই ভোল্টেজ’ তদবিরেও মিলছে না আইসিইউ।
ওই চিকিৎসাকর্মী বলেন, কি মনে করেন? আইসিইউতে সিট কয়টা? এতো রোগীর জায়গা দিবে কিভাবে? হাইভোল্টেজ তদবির আছে। তাছাড়া হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের আইসিইউতে অগ্রাধিকার। কোভিড সংক্রমণের অতি উচ্চহারের এই সময়ে নিদারুণ সংকটে রাজধানীর মুমুর্ষূ রোগীরা। সাধারণ মানুষের জন্যে আরো দুরূহ চিকিৎসা পাওয়া।
ঢাকা মেডিক্যালে বাবার জন্য তিনদিন আগে আইসিইউ এর সিরিয়াল দিয়েছিলেন মিথুন কুন্ডু। সিরিয়াল ছিলো একশো। জরুরি অবস্থায় মিথুনের বাবাকে এইচডিইউতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
তিনি জানেন না শেষ পর্যন্ত বাবার জন্য আইসিইউ ব্যবস্থা করতে পারবেন কিনা।
রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে জায়গা না পেয়ে শেষে ঢাকা মেডিক্যালের কোভিড ইউনিটের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী নিয়ে অপেক্ষায় স্বজনরা। কোনো রোগী সুস্থ হলে কিংবা মারা গেলে তবেই খালি হয় একেকটি আইসিইউ শয্যা। আর সেই শয্যা কাকে দেয়া হবে- তা ঠিক করা অনেকটাই কঠিন হয়ে যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জন্য।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ‘চারজন এইচডিইউ থেকে আমাদের আইসিইউ’তে নিতে হবে। একটা বেড খালি হবে, ডক্টর বলছে এক রোগীর অবস্থা ক্রিটিকাল। এই এক বেডে কে যাবে সেই ডিসিশানটা নেয়া কঠিন। অনেক সময় মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমাদের।’ মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ জানান, ‘দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তি, তাদের জন্য আমরা কাছে ফোন আসে। বলে আইসিইউ বেড খালি আছে কিনা, যদি আমাকে দিতে পারেন। আমি অপারগতা প্রকাশ করি, কারণ আমার এখানে খালি নাই।
অনেকেই হাসপাতালে আসেন একেবারে শেষ মুহূর্তে, অবস্থা জটিল হওয়ার পরে। ফলে তাদের ব্যবস্থাপত্র দেয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে যায়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক আরো বলেন, ‘উদাসীনতা হোক, অথবা না জেনে হোক, কিন্তু যখন আসছে আমাদের কাছে তখন ৮০’র নিচে, ৬৫ এর নিচে অক্সিজেন স্যাচুরেশন নিয়ে আসছে। তখন আমরা অনেক চেষ্টা করেও তাকে কোনভাবেই ভালো করতে পারি না। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে দেরি না করে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ চিকিৎসকদের।
রাজধানীর উত্তরখানের মোহাম্মদ রায়হানের মা মনোয়ারা বেগমকে বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন সাপোর্ট দরকার ছিল। মনোয়ারাকে বাঁচাতে ছেলে রায়হান অ্যাম্বুলেন্সে মাকে নিয়ে রাজধানী ঢাকার এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটেছেন। গুরুতর অসুস্থ মাকে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেন। সেখানে অক্সিজেন সাপোর্ট মেলেনি। অতপর বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও আল রাজি ইসলামী হাসপাতাল হয়ে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানেই অক্সিজেনের অভাবে অ্যাম্বুলেন্সেই পুত্রের কোলে মায়ের মৃত্যু হয়।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের আলী মোর্শেদ নোটনের স্ত্রীর করোনাভাইরাস ধরা পড়লে ২৪ মার্চ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু চার দিন পর চিকিৎসক যখন তাকে আইসিইউতে নিতে বললে ঢাকা মেডিক্যালের কোভিড ইউনিটে আইসিইউ শয্যা খালি নেই। ঢাকার সরকারি-বেসরকারি সবগুলো কোভিড হাসপাতালে যোগাযোগ করে কোথাও আইসিইউ পাননি। পরে গ্রিনরোডের এক হাসপাতালে অধিক মূল্যে একটি আইসিইউ শয্যা পেয়ে স্ত্রীকে দ্রæত সেখানে ভর্তি করান। তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন।
দেশের করোনা চিকিৎসার এই ভয়াবহ চিত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যেও এসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘বর্তমানে হাসপাতালে তিল ধরণের ঠাঁই নেই। মানুষের অসচেতনতার কারণে যে হারে করোনা রোগী বাড়ছে সামনে সারা দেশকে হাসপাতাল বানালেও করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না’। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতালেও শয্যা পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।
অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুরের ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মেডিক্যাল হাসপাতালসহ অনেক সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের ভর্তি করানো হচ্ছে না। কোথাও আবার সাধারণ রোগীদের ভর্তি না করিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।