সিলেট৭১নিউজ ডেস্ক: এবার আসছে সারা দেশে সাত দিনের জন্য কঠোর লকডাউন। এটি চলবে আগামী ১৪ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত। এ সময়ে জরুরি সেবা ছাড়া সবধরনের সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিল্পকারখানা, মার্কেট-দোকানপাট, যানবাহনসহ সবকিছু বন্ধ রাখার চিন্তা করা হয়েছে।
করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় এবং স্বাস্থ্যবিধির প্রতি জনগণের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে সর্বাত্মক লকডাউনের পরিকল্পনা করেছে সরকার। ১৩ এপ্রিলের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
গত তিন সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বেশকিছু বিধিনিষেধ সাত দিনের জন্য আরোপ করেছে সরকার।
৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া চলমান এই বিধিনিষেধের মধ্যেই এলো কঠোর লকডাউনের ঘোষণা। এসব বিধিনিষেধ প্রতিপালনে সংশ্লিষ্টদের অনীহায় প্রতিদিনই বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা।
এমন পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ আরও শক্তভাবে অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য পূর্ণ লকডাউন দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কোভিড সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
বিশেষ করে সিটি করপোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় পূর্ণ লকডাউন দেওয়ার সুপারিশ করা হয় কমিটির পক্ষ থেকে। এমন সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার এক সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
শুক্রবার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে ৭ দিনের জন্য কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হবে। এই সময়ে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত সব বন্ধ থাকবে।
তিনি জানান, ‘প্রধানমন্ত্রী গতকাল লোক প্রশাসন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ৭১তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে বলেছেন, মানুষকে বাঁচাতে আমাদের আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ভাবছে আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত কঠোর লকডাউন দেওয়া হবে।
যাকে বলে ‘কমপ্লিট লকডাউন’। এটা সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। মানুষকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার প্রক্রিয়া চলছিল। তারই অংশ হিসাবে আমরা মার্চে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলাম, এপ্রিলে আরও কঠোর বিধিনিষেধ দিলাম।
এখন আমরা ১৪ তারিখ থেকে এক সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউন দেব। এই সময়ে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত সব বন্ধ থাকবে। গার্মেন্ট, শিল্পকারখানা সব বন্ধ থাকবে। দেশের মানুষ যে যেখানে আছে, সেখানেই থাকবে।
সব ধরনের যানবাহন বন্ধ থাকবে। শুধু জরুরি সেবায় জড়িতরা কাজ করবে। তবে জরুরি কাজ ছাড়া কেউ বাইরে আসতে পারবে না। সরকার আশা করছে, সবাই সহযোগিতা করবে। সংক্রমণ কমাতে এর বিকল্প নেই।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামী ১৩ তারিখের মধ্যেই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হবে। এ ছাড়া লকডাউন পরবর্তী সময়ে বাড়ানো হবে কি না, সে বিষয়ে আগামী ২০ তারিখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এর আগে শুক্রবার সকালে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার, সঙ্গে বাড়ছে জনগণের অবহেলা ও উদাসীনতা।
তিনি আরও বলেন, চলমান এক সপ্তাহের লকডাউনে জনগণের উদাসীন মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। তাই সরকার জনস্বার্থে আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য সর্বাত্মক লকডাউনের বিষয়ে সক্রিয় চিন্তাভাবনা করছে।
ওবায়দুল কাদের সকালে তার সরকারি বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় গত ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত সারা দেশে শপিং মল, দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও গণপরিবহণ বন্ধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ১১ দফা নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার।
এরপর এটি কিছুটা শিথিল করে বুধবার থেকে সিটি করপোরেশন এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকাল-সন্ধ্যা গণপরিবহণ চালু এবং শুক্রবার থেকে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শপিংমল ও মার্কেট খোলার অনুমতি দেয়।
পরামর্শক কমিটির সুপারিশ : সারা দেশে উদ্বেগজনকভাবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। এ অবস্থায় বুধবার রাতে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ৩০তম সভা অনুষ্ঠিত হয়।
কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা সভাপতিত্ব করেন। সভায় বেশকিছু সুপারিশ গৃহীত হয়। সেখানে বলা হয়, সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত ১৮টি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও করোনা নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। এগুলো সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না, সংক্রমণের হার বাড়ছে। বিধিনিষেধ আরও শক্তভাবে অনুসরণ করা দরকার।
অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য পূর্ণ লকডাউন ছাড়া এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলে সভায় মতামত ব্যক্ত করা হয়। বিশেষ করে সিটি করপোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় পূর্ণ লকডাউন দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
দুই সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগে সংক্রমণের হার বিবেচনা করে আবার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। শয্যাসংখ্যা, আইসিইউ সুবিধা, অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচেষ্ট।
ডিএনসিসি হাসপাতাল আগামী সপ্তাহের মধ্যে চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সরকারি পর্যায়ের এই কার্যক্রমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তির বাড়তি চাপ থাকায় অতি দ্রুত আরও সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।
সভায় আরও বলা হয়, সংক্রমণের হার বাড়ার কারণে করোনা পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোয় রোগীর ভিড় বাড়ছে, রিপোর্ট পেতেও সময় লাগছে। যারা পরীক্ষা করতে আসছেন তাদের একটা বড় অংশ বিদেশগামী যাত্রী।
বিদেশে অভিবাসী কর্মজীবী মানুষ ছাড়া অন্য যাত্রীদের বেসরকারি পরীক্ষাগারে পাঠাতে পারলে সরকারি ল্যাবরেটরিতে চাপ কিছুটা কমবে। বিদেশে অভিবাসী কর্মজীবী মানুষ ছাড়া অন্য যাত্রীদের পরীক্ষা বেসরকারি পরীক্ষাগারে পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন।
এতে রোগীদের পরীক্ষা ও রিপোর্ট দ্রুত প্রদান করে আইসোলেশন নিশ্চিত করা যাবে, যা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, টিকা দেওয়ার কার্যক্রম যুক্তরাজ্যে ফলপ্রসূ হয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশেও টিকা কর্মসূচি সফল করতে টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মধ্যে বেসরকারিভাবে টিকা আমদানি করে টিকাদানের সুপারিশ পুনরায় করা হলো।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মোশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, গত সোমবার থেকে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কার্যকারিতা বোঝা যাবে আগামী দুই সপ্তাহ পর।
এ ছাড়া মৃত্যুর পরিস্থিতি বোঝা যাবে আগামী তিন সপ্তাহ পর। তবে এ সময়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমাতে সরকার নতুন করে যে কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে, পরিস্থিতি উত্তরণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে প্রান্তিক মানুষের জীবন ধারণের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। একই মাসের ১৮ তারিখে দেশে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।
অর্থাৎ, ২৬ মার্চের ছুটি থেকে শুরু হয়ে সাপ্তাহিক নিয়মিত ও সাধারণ ছুটি মিলিয়ে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি অফিস, যানচলাচল বন্ধ থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পরবর্তীকালে এই ছুটি ৩১ মে পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হয়। সেই সময়ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও হাসপাতালসহ জরুরি সেবা বিভাগগুলো এই ঘোষণার আওতামুক্ত রাখা হয়।
এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে নয় হাজার ৫৮৪ জন, শনাক্ত হয়েছে ছয় লাখ ৭৩ হাজার ৫৯৪ জন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪১ জন। বর্তমানে আক্রান্তের সংখ্যা ৯৫ হাজার ৪৬৯ জন।
সিলেট৭১নিউজ/টিজা