সিলেট৭১নিউজ ডেস্ক: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাতক্ষীরায় আগমনকে ঘিরে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা হয়েছে গোটা সাতক্ষীরা। আগামী ২৭ মার্চ তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবীর ৫১ শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম পবিত্র একটি শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিত সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুর যশোরেশ্বরী কালীমন্দির পরিদর্শন করবেন।
তার আগমনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনে মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থ স্থান হিসেবে পরিচিত ঈশ্বরীপুর কালীমন্দির সংলগ্ন হিন্দু ও মতুয়া সম্প্রদায়ে চলছে উৎসবের আমেজ।
সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এস এম জগলুল হায়দার ও জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, বাঙ্গালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শুক্রবার (২৬ মার্চ) বাংলাদেশ সফরে আসবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পরদিন ২৭ মার্চ তিনি হেলিকপ্টার যোগে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী হিসেবে খ্যাত ধুমঘাট এলাকার ঈশ্বরীপুর যশোরেশ্বরী কালীমন্দির পরিদর্শন করবেন। আর সে কারণেই মন্দির এবং সংলগ্ন এলাকা সাজানো হয়েছে নান্দনিক সাজে।
তিনি আরও জানান, সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে শ্যামনগরের সোবাহান মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠের হেলিপ্যাডে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে অবতরণ করবেন মোদি। পরে যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে প্রবেশ করে পূজা অর্চনায় যোগ দেবেন তিনি। ফলে গোটা ঈশ্বরীপুর ও মন্দিরসংলগ্ন এক থেকে দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ঈশ্বরীপুর-সহ পুরো শ্যামনগর উপজেলা।
এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে গত ২৩ মার্চ থেকে গোটা সাতক্ষীরায় নিশ্ছিদ্র বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে আইনঙ্খলা বাহিনী। সাতক্ষীরা শহর থেকে শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুর মন্দির পর্যন্ত রাস্তার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছে র্যাব-৬ এর টহল দল, পুলিশ ও সাদা পোশাকে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
র্যাব-৬ সাতক্ষীরা ক্যাম্পের উপ-সহকারী পরিচালক জিয়াউল ইসলাম জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাতক্ষীরা শহর থেকে সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর পর্যন্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। র্যাব-৬ সাতক্ষীরার এএসপি বজলুর রশীদের নেতৃত্বে রাস্তার গুরুপূর্ণ স্থানগুলোতে বিশেষ নিরাপত্তা চেকপোস্ট রোবাস্ট পেট্রোলিং-সহ ও বিশেষ নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে।
সাতক্ষীরা থেকে শ্যামনগর অভিমুখে ৪টি স্থানে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকারসহ সব ধরনের যানবাহন দাঁড় করিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকেও শ্যামনগর উপজেলাজুড়ে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও গোয়েন্দা নজরদারি।
এদিকে, বিশ্ববরেণ্য নেতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বরণ করার অপেক্ষায় শ্যামনগরের মতুয়া ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। উচ্ছসিত সাতক্ষীরাবাসীও।
সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শ্যামনগর উপজেলা। আর এই উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ঈশ্বরীপুরের অবস্থান। দীর্ঘদিন পরে হলেও মোদির আগমনে একটা আনন্দ-উচ্ছাস দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম স্মৃতিবহুল স্থান ঈশ্বরীপুর মানুষের মধ্যে। নরেন্দ্র মোদির আগমনে ঈশ্বরীপুরের অজপাড়া গাঁ-টি সেঁজেছে নতুন ঢঙে। যেটি এক সময় রাজা-বাদশাদের পদচারণায় মুখরিত ছিল, সেটি এখন শুধুই স্মৃতি। এখানে ছিল যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী, যার নাম ধুমঘাট।
প্রতাপাদিত্যের রাজধানীতে দীর্ঘকাল কোনও দেশবরেণ্য ও নামিদামি মানুষের পর্দাপণ ঘটেনি। হঠাৎ করেই দেশের গন্ডি পেরিয়ে প্রতিবেশি বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে ঈশ্বরীপুর-সহ ধুমঘাটের পুরো এলাকা।
সনাতনধর্মাবলম্বীদের কাছে ৫১ শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম পবিত্র একটি শক্তিপীঠ ঈশ্বরীপুর যশোরেশ্বরী মা কালীমন্দির। আর মাত্র একদিন পরেই এই মন্দিরে পূজাঅর্চনায় যোগ দেবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নবাব সোলায়মানের পুত্র নবাব দাউদ শাহের স্বাধীনতার চেতনা থেকেই কালক্রমে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যশোর রাজ্যের রাজধানী। ১৫৭৩ সালে সিংহাসনে বসেন দাউদ শাহ। তার দুই বাল্যবন্ধু শ্রীহরিকে ‘বিক্রমাদিত্য’ এবং জানকিকে ‘বসন্ত রায়’ উপাধি দিয়ে তিনি তাদের মন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। সুন্দরবনঘেরা দেশের এই দক্ষিণ পশ্চিমের জনপদে জলদস্যু,মগ, পর্তুগিজদের লুটতারাজ এবং সুন্দরবনের দস্যু দমনের জন্য নবাব দাউদ শাহ বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায়কে দায়িত্ব দেন। বসন্ত রায় এখানে এসে ঘাঁটি গাড়েন। সে কারণে এখানকার নাম হয় বসন্তপুর। বিক্রমমাদিত্যকে দেওয়া হয় অন্য এলাকার দায়িত্ব। বিক্রমাদিত্যের পুত্র প্রতাপাদিত্য পিতার জীবদ্দশায় আরও একটি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেন। সে সময়ে নবাব দাউদ শাহের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় দিল্লির সম্রাট আকবরের। সম্রাট আকবর নবাব দাউদ শাহকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিরাট এক রণতরী ও সৈন্যবহর নিয়ে যুদ্ধে চলে আসেন। সম্রাট আকবর ও নবাব দাউদ শাহের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় রাজমহল নামক স্থানে। দীর্ঘ যুদ্ধে দাউদ শাহ পরাজয় বুঝতে পেরে গোপনে তার সমুদয় ধনসম্পদ পাঠিয়ে দেন রাজা প্রতাপাদিত্যের কাছে। বিপুল সম্পদ নিয়ে পরে প্রতাপাদিত্য ঈশ্বরীপুরে তৈরি করেন এক বিলাসবহুল রাজধানী। এক স্থানের ‘যশ’(সম্পদ) অন্যস্থানে এনে রাজ্য গড়ার কাহিনী লোকমুখে ফিরতে ফিরতে এ এলাকার নাম হয় যশোহর। রাজা প্রতাপাদিত্য নিজেকে ১৫৯৯ সালে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। রাজা প্রতাপাদিত্য এই ঈশ্বরীপুরে নির্মাণ করেন বহু ইমারাত ও দুর্গ। ইতিহাসের এই স্মৃতিস্তম্ভ গুলো আজও মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ৫ গম্বুজবিশিষ্ট ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ, কিছুদূর গেলেই পাশেই চোখে পড়বে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পবিত্র যশোরেশ্বরী কালীমন্দির। এ মন্দিরের একটু দূরেই রয়েছে একটি পুরাতন ভবন। স্থানীয়ভাবে এটি হাবসিখানা বলে পরিচিত। অনেকের মতে, এখানে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা ক্রীতদাসদের রাখা হতো এবং একইসাথে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের শাস্তি দেওয়া হতো।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনে ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত চিহ্ন ও স্থানগুলো দেখতে প্রতিদিন লোকসমাগম হলেও রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণের দাবি ও ইতিহাস জানার ব্যবস্থার দাবি তুলেছেন এলাকাবাসী।
সিলেট৭১নিউজ/টিজা