সিলেট অফিস: সিলেটে চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই ২ মাসে নারী-পুরুষ-কিশোর-শিশুসহ ১৬ জন খুন হয়েছেন। প্রেম ঘটিত বিষয় নিয়ে, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে, পারিবারিক কলহ ও সম্পত্তি নিয়ে বিরোধসহ ছোট খাটো বিরোধ নিয়ে ঘটছে এসব খুনের ঘটনা।
এই ২ মাসে সিলেট নগরী, শহরতলী ও বিভাগে ১৬ টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সিলেট নগরী ও জেলায় ৯টি, সুনামগঞ্জে ৩টি, হবিগঞ্জে ২টি এবং মৌলভীবাজারে ২ জন খুন হন। নিহতদের মধ্যে দিনমজুর, কৃষক, প্রবাসী, গৃহবধূ, শিশু-কিশোর ও চিকিৎসক রয়েছেন।
১ ফেব্রুয়ারি নগরীতে রেজাউল করিম হায়াত (৫০) নামে এক পল্লী চিকিৎসকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওইদিন দুপুর ১২টায় লালবাজারস্থ মোহাম্মদীয়া আবাসিক হোটেলের পেছন থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত চিকিৎসক রেজাউলের বাড়ি সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কালাছাদেক গ্রামে। এ ঘটনায় ২ জনকে সন্দিগ্ধ আসামী হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
২ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় পৈত্রিক ভিটেজমি নিয়ে বিরোধের জেরে চাচাতো ভাইয়ের হাতে সৌদি প্রবাসী শামীম আহমদ খুন হন। ওইদিন দুপুরে কুলাউড়ায় উপজেলার রাউৎগাঁও ইউনিয়নের মুকন্দপুর গ্রামে এই ঘটনাটি ঘটে। নিহত শামীম ওই এলাকার মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে।
৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সিলেট সদর উপজেলায় ছুরিকাঘাতে রাজু দাস (২২) নামের এক যুবক খুন হন। তিনি জালালাবাদ থানাধীন হালদারপাড়া মজুমদার পল্লীর চন্দ্র দাসের পুত্র। পুলিশ জানায়, মোবাইল বিক্রির পাওনা ২০০ টাকার বিরোধের জের ধরে রাজুকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সজল নামের একজনকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ওইদিন সুনামগঞ্জের ছাতকে পারিবারিক কলহের জেরে বড় ভাইয়ের বল্লমের আঘাতে ছোট ভাই মারা যান। নিহত পারভেজ মিয়া (৩৮) ছাতক উপজেলার কালারুকা ইউনিয়নের জামুরাইল গ্রামের মৃত লিলু মিয়ার পুত্র।
৫ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জে বানিয়াচং উপজেলায় ঘরে ঢুকে জাকিয়া খাতুন (৬৫) নামে এক গৃহবধূকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। রাত সাড়ে ৭টায় হবিগঞ্জে বানিয়াচং উপজেলার ৩নং দক্ষিণ-পূর্ব ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত জাকিয়া খাতুন ওই এলাকার মৃত হান্নান ঠাকুরের স্ত্রী। ওই দিন বহুবল উপজেলার স্নানঘাট ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামে ক্ষেতের জমিতে পানি সেচ নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের ফিকলের (দেশীয় অস্ত্র) আঘাতে জামাল মিয়া (৩৫) নামের এক কৃষক মারা যান। দুপুর ১টায় বহুবল উপজেলার স্নানঘাট ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামে এ ঘটনাটি ঘটে। নিহত যুবক উপজেলার ফতেহপুর গ্রামের গেদু মিয়ার পুত্র।
৬ ফেব্রুয়ারি সকালে জগন্নাথপুর উপজেলায় পারিবারিক কলহের জেরে দ্বিতীয় স্ত্রী’র লাঠির আঘাতে স্বামী খুন হন। নিহত মো. আলেক মিয়া (৬৫) উপজেলার পাইলগাও ইউনিয়নের আমিনপুর গ্রামের মৃত মাছিম উল্ল্যাহর পুত্র। তিনি পেশায় একজন দিনমজুর। নিহত আলেক মিয়ার প্রথম স্ত্রীর ঘরে ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে থাকলেও দ্বিতীয় স্ত্রীর কোন সন্তান নেই। তিনি থাকতেন দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে। খুন হওয়ার ১০ ঘন্টার মধ্যে ঘাতক স্ত্রীকে গ্রেফতার করেছে জগন্নাথপুর থানা পুলিশ।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়নের গোতগাঁও (আমিনপুর) গ্রামের দিনমজুর আলেক মিয়া (৫০) ৩ মাস আগে রানীগঞ্জ ইউনিয়নের বাগময়না (টেকুয়া) গ্রামের মৃত আরমান মিয়ার স্বামী পরিত্যক্ত মেয়ে রেনু বেগম (৩০) কে দ্বিতীয় বিয়ে করেন।
৮ সোমবার ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে ছোট ভাইয়ের দায়ের কুপে বড়ভাই খলিল উদ্দিন (৫৫) খুন হয়েছেন। দিবাগত রাত দুইটায় উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউপির পূর্ব ঘোলসা গ্রামে এই ঘটনাটি ঘটেছে। খলিল উদ্দিন ওই গ্রামের মৃত সিকন্দর আলীর পুত্র। পরদিন মঙ্গলবার সকালে হত্যাকারী ছোটভাই আব্দুল খালিককে (৫৩) গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে।
এদিকে বিকেলে পুলিশ গ্রেফতার আসামী আব্দুল খালিককে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে।
১৮ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২টার দিকে সিলেট সদর উপজেলার বিআইডিসি মীরমহল্লায় ভাড়া বাসায় সৎ মা রুবিয়া (৩০), মেয়ে মাহা (৭) ও ছেলে তাহসানকে কুপিয়ে হত্যা করে আহবাব হোসেন আবাদ। ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও সে হত্যার ঘটনা স্বীকার করে। এ ঘটনায় পরদিন শুক্রবার রাতে নিহতের ভাই আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে শাহপরান (র.) থানায় হত্যা ও প্ররোচনার দায়ে ৩০২ ও ১০৯ ধারায় মামলা (নং-১৮(২)২০২১) দায়ের করেন। মামলায় নিহতের সৎ ছেলে আবাদ ছাড়াও হত্যার প্ররোচনার দায়ে তার মা সুলতানা বেগম রুমিকেও আসামি করা হয়েছে।
২০ ফেব্রুয়ারি হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় আবাদ। সিলেটে মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তৃতীয় আদালতের বিচারক শারমিন খানম নীলা ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করে কারাগারে প্রেরণের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন। নিহত রুবিয়া বেগম, শিশু মাহা ও তাহসান সিলেট শহরতলীর মীরমহল্লা এলাকার ভাড়াটে বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবদাল হোসেন বুলবুলের স্ত্রী ও সন্তান। অন্যদিকে, হত্যা মামলায় প্রেফতার আবাদ বুলবুলের প্রথম স্ত্রীর ঔরসজাত সন্তান।
২১ ফেব্রুয়ারি সিলেট নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় ভাড়া নিয়ে বাকবিতন্ডার জেরে অগ্রণী ব্যাংক কর্মকর্তা মওদুদ আহমদ মারা যান। সিএনজি অটোরিক্সা চালক নোমান হাছনুর সহ তার কয়েকজন সহযোগী ব্যাংক কর্মকর্তা মওদুদ আহমদকে মারধর করে। তাকে গুরুতর আহতবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত মওদুদ সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় অগ্রণী ব্যাংকের হরিপুর গ্যাস ফিল্ড শাখার কর্মকর্তা ছিলেন। তার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরের বাসিন্দা।
এ ঘটনায় নিহত মওদুদের বড় ভাই আব্দুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় অটোরিকশাচালক নোমান হাছনুকে প্রধান আসামী কে এবং অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
২৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটের মেজরটিলা সৈয়দপুরের রহস্যভাবে বাসার ছাদ থেকে পড়ে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। নিহত সুলতানা বেগম (৪০) সৌদি আরব প্রবাসী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী। তার পরিবারের সদস্যদের দাবি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। বুধবার বিকাল ৫টার দিকে সৈয়দপুর সি ব্লকের মা ভবনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ভবনের ৫ম তলার ছাদ থেকে পড়ে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
২৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় বোনের সংসার বাঁচাতে গিয়ে বোন জামাইর হাতে দিপু বিশ্বাস (৩৫) নামে এক যুবক খুন হয়েছেন। ঐদিন রাতে উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের জয়কলস গ্রামে (নমশুদ্রপাড়া) এ ঘটনা ঘটে। ঘটনায় ঘাতক বোন জামাই রনু বিশ্বাস (৩৫) কে আটক করেছে পুলিশ। সে পেশায় ঝালমুড়ি বিক্রেতা।
২৭ ফেব্রুয়ারি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে সালিশ বৈঠক শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে ইন্তাজ আলী (৪৫) নামে এক ব্যবসায়ী খুন হয়েছেন। সকাল ১১টায় উপজেলার ভোলাগঞ্জ গুচ্চগ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ইন্তাজ আলী মরহুম ইউনুস আলীর পুত্র। এ ঘটনায় আরজ আলীকে গ্রেফতার করেছে কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশ। স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক সমস্যা নিরসন করে স্থানীয় মুরব্বিদের সালিশ বিচার শেষ করে ফেরার পথে সকাল ১১টার দিকে একই গ্রামের কেরামত আলীর ছেলে আরজ আলী ইন্তাজ আলীকে ছুরিকাঘাত করলে তিনি গুরুতর আহত হন। এ সময় তাঁকে উদ্ধার করে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত্যু ঘোষণা করেন।
সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. জেদান আল মুসা জানান, খুনের ঘটনা বাড়ার পেছনে নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়লে মানুষের মাঝে নিষ্ঠুরতার মাত্রা বেড়ে যায়। এতে খুন-খারাবী বাড়ে। শুধু আইন আর শাস্তি দিয়ে সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব নয়।
গত ১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সিলেট সদর উপজেলার খাদিমপাড়ার বিএডিসি কৃষি গবেষণা খামারের লেকের পাশে থাই মিস্ত্রি নাঈম আহমদকে খুন করে লাশ ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে সেখান থেকে ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত নাঈম সদর উপজেলার খাদিমপাড়ার পাঁচঘড়ি এলাকার নিজাম উদ্দিনের পুত্র। তিনি স্থানীয় মেজরটিলা মোহাম্মদপুর এলাকায় নানার বাড়িতে থাকতেন। নিহতের বুকে-পিঠে ৮টি ছুরিকাঘাত করা হয়। তার দুই হাতে নাম্মী নামে জনৈক মেয়ের নাম দিয়ে ট্যাটু আঁকা এবং বাম হাতে অসংখ্য ব্লেডের পুরনো কাটা দাগের চিহ্ন ছিল। ঘটনার দিন হত্যাকান্ডে জড়িত দেলোয়ার হোসেন সবুজকে (২২) গ্রেফতার করা হয়। নিহত সবুজ সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের গুলি চা বাগানের লাল মিয়ার পুত্র। মহানগর পুলিশের শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আনিসুর রহমান বলেন, হত্যার ঘটনায় জড়িত মোট ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অলি আহমদ সানিকে সিলেটের গোলাপগঞ্জ থেকে এবং হিমেলকে নগরীর বালুচর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
হত্যার নেপথ্যের প্রকৃত কারণ উদঘাটনে অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে- গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়ার চরখুলী গ্রামের হেবল ফুলিয়ার পুত্র নগরীর সেনপাড়া পুষ্পায়ন ৪৬ নম্বর বাসার বাসিন্দা পিন্স হিমেল (১৬) ও সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর সেলিমপুরের হেলাল উদ্দিনের পুত্র নগরীর শিবগঞ্জ সেনপাড়া পুষ্পায়ন ১৩/১ বাসার মোহাম্মদ অলি আহমদ সানি (১৭)।
মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) বিএম আশরাফ উল্ল্যাহ তাহের বলেন, নাঈম হত্যার ঘটনায় নিহতের মা জাহানারা বেগম বাদী হয়ে ৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪/৫ জনকে আসামি করে নগরী শাহপরান (র.) থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আটক ৩ জনকে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।