তালা ভেঙে ছাত্রী মেসে বহিরাহগত যুবকের অনুপ্রবেশ, গোসলের সময় ছাত্রীর ভিডিও ধারণ, ছাত্রী মেস থেকে ল্যাপটপ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চুরি, আবাসিক এলাকাতে থাকতে বিধি-নিষেধ জারি, সিএনজিতে ছিনতাইয়ের শিকারসহ বিভিন্ন ধরণের হয়রানিমূলক ও অপ্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে নিরাপত্তাহীনতা ও মানসিক সমস্যায় ভুগছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এ ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলেও কোন ধরণের সমাধান পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। ঘটনাগুলোতে সংশ্লিষ্টরা তৎক্ষণাৎ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা পুলিশকে জানালেও স্থায়ী সমাধানের কোন প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ নিতে দেখা যায় নি। ফলে অপ্রীতিকর ঘটনার কোন সমাধান না পেয়ে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীরা এসব ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি মাননিক সমস্যায় ভুগছে।
এমনটা কেন হচ্ছে? কেন এত অনীহা? যারা এগুলোর সাথে জড়িত তারা কি আদৌও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে? প্রশাসনের কি কিছুই করার নেই? এমন নানা প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন শিক্ষার্থীরা। এমনকি অধিকাংশ সময় প্রশাসন বিষয়গুলো নিয়ে দায় সারা কাজ করেন বলেও অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রতিবারই এমন অপ্রীতিকর ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে কেউ না কেউ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তদারকিতে ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত হয়। কিন্তু এর পর আর কোন খোঁজ খবর থাকে না কারোরই। অধিকাংশ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী কেউই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন ধরণের মামলা দায়ের অথবা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে চায় না। থাকে না প্রশাসনের কোন কার্যকরী পদক্ষেপ, ফলে ধীরে ধীরে বিষয়টি প্রতিনিয়ত হাজারো ঘটনার পেছনে চাপা পড়ে থাকে।
জানা যায়, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ১৭ ডিসেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরী সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আবাসিক হল খোলা ছাড়াই ১৭ জানুয়ারি মধ্যে অনার্স শেষ বর্ষ ও মাস্টার্সের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে প্রশাসনের নিকট আবাসিক হল খোলাসহ বিভিন্ন দাবি জানায় শিক্ষার্থীরা। এসময় শিক্ষার্থীদের দাবি অগ্রাহ্য করে পরীক্ষা শুরু করে বি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে নিরুপায় হয়ে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আর্থিক অসংগতির মধ্যেও সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় মেস-বাসা ভাড়া নেয়।
পরে, ১৭ ফেব্রুয়ারি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ১ম, ২য় ও ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা ১লা মার্চ থেকে শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে আবারও শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে সিলেট আসতে শুরু করে। সিলেটে এসে আবাসন ব্যবস্থা না করতে পেরে হল খুলে দিতে বিশ^বিদ্যালয়ের গোলচত্বরে ও উপাচার্যের বাসভবনে প্রবেশের এককিলো সংলগ্ন রাস্তায় অবস্থান নেয়। এমনকি উপাচার্য বাসভবন সংলগ্ন গেইটে তালা ঝুলিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। পরে সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত আসায় আগামী ২৪ মে পর্যন্ত সকল পরীক্ষা স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এদিকে পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ি বিভিন্ন বিভাগের পরীক্ষার রুটিন হয়ে যাওয়ায় অগ্রিম কয়েক মাসের জন্য ভাড়া পরিশোধ করে মেস ভাড়া নিয়ে নিয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। এতে নিরুপায় হয়ে অনেকেই সিলেটে অবস্থান করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে অবস্থানের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরণের চুরি, ছিনতাই, শ্লীলতাহানিসহ বিভিন্ন ধরণের হয়রানিমূলক ও অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার (৫ মার্চ) রাতে সিলেট নগরীর আবাসিক এলাকাস্থ মেয়ে শিক্ষার্থীদের এক মেসে বহিরাগত যুবক কর্তৃক ভেন্টিলেটর দিয়ে এক শিক্ষার্থীর গোসলের ভিডিও ধারনের অভিযোগ উঠেছে। পরে ঐ শিক্ষার্থী চিৎকার করলে যুবকটি পালিয়ে যায়। এতে করে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ধারনকৃত ভিডিও ফাঁস ও ব্লাকমেইলের আশঙ্কাতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
শুধু এ ঘটনা নয়, এর আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সিলেটের সুবিদবাজারস্থ নুরানী পুকুরপাড় এলাকার ত্রয়ী কুটিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীদের মেসে চুরি হয়। এসময় একটি ল্যাপটপ, নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চুরি ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পাশাপাশি তারা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে বলেও বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনকে জানায়। এছাড়া গত ২১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক সংলগ্ন ইনায়া ম্যানশনের চতুর্থ তলায় ছাত্রীদের মেসের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশের দায়ে বহিরাগত এক যুবককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে এলাকাবাসী। এছাড়া সুরমা আবাসিক এলাকা ও আখালিয়া আবাসিক এলাকাতে মেয়ে শিক্ষার্থীদেরকে বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলা, মেসে বিভিন্ন ভাবে উৎপাত সৃষ্টিসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনা ছাড়াও প্রায়ই সিলেট নগরীর বিভিন্ন জায়গা, সুবিদবাজার, পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, সুরমা আবাসিক এলাকা, আখালিয়া, টিলারগাঁসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক সংলগ্ন বিভিন্ন আবাসিক এলাকাতে শিক্ষার্থীরা নানা ধরণের ভোগান্তি, চুরি, ছিনতাই এলাকার বখাটে ছেলে কর্তৃক উত্ত্যক্তকরণসহ বিভিন্ন ধরণের হয়রানির শিকার হয়ে থাকে শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া শিক্ষার্থীরা নিয়মিত সিএনজিতে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। এতে করে চালক কিংবা যাত্রী কর্তৃক ছিনতাই এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদেরকে উত্ত্যক্তকরণ কিংবা যৌন হয়রানির শিকারও হতে হয়। এমনকি শারীরিকভাবে লাঞ্চিত ও হতাহতের ঘটনা শিকার হতে হয় শিক্ষার্থীদেরকে। নাম প্রকাশে অনিচছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেয়ে শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আমাদেরকে অবিভাবক হিসেবে নিজেদেরকে দাবি করে। কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যে সে ধরণের অবিভাবক সুলভ আচরণ নেই। পরীক্ষার শুরুর কথা বলে আমাদেরকে সিলেটে নিয়ে আসলেও হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা শুরু করে। গত কয়েক মাস থেকে যে ধরণের ঘটনা আমাদের সাথে ঘটছে তা নিয়ে কারোরই মাথা ব্যাথা নেই। আসলে বড় ধরণের কোন দূর্ঘটনা না ঘটলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের টনক নড়বে না। এমনই ভাবে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নানা মুখী সমালোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা নিয়ে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হুদা খান বলেন, বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে সর্বদা আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখে। কিন্তু ক্যাম্পাসের বাইরে সাধারণ মানুষের চলাচল। এখানে একজন শিক্ষার্থী আর একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন। নিরাপত্তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক আমাদের পুলিশের একটা পার্টি আছে যারা বিশ^বিদ্যালয় এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে। এছাড়া পুলিশের টহল তো থাকেই। তারপরও বিশ^বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় আমাদের কাছে খবর আসে। আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করি।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আবু হেনা পহিল বলেন, আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ে শতভাগ আবাসন ব্যবস্থা নেই। ২৫ শতাংশের মতো শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা থাকলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে বাইরে বিভিন্ন হোস্টেল ও মেস নিয়ে থাকে। এতে করে সাধারণ জনগণের মধ্যেই মিলে মিশে থাকতে হয় শিক্ষার্থীদেরকে। এজন্য ছোট-বড় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় শিক্ষার্থীদেরকে। আমরা নিয়মিতই সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি।
স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ নিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর বলেন, আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি আবাসিক হল নির্মাণ হবে। ইতোমধ্যে দুইটা হল নির্মাণের কাজ চলছে। আগামীতে আরও হবে। এতে করে ক্যাম্পাসের ভিতরেই শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে নিরাপত্তা রিলেটেড সমস্যাগুলো হয়তো আর থাকবে না।
‘তারপরও আমরা সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের সাথে কথা বলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে আমাদেরকে জানিয়েছেন পুলিশ কর্তৃপক্ষ।’
তিনি আরও বলেন, অনেক শিক্ষার্থী বাড়িতে না গিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে সিলেট আছে। তারা কে কোথায় থাকছে আসলে সবার বিষয়ে তো আর জানা নেই। তারপরও বলবো, যেহেতু ক্যাম্পাস ২৪ মে এর আগে খুলছে না সেহেতু শুধু শুধু বাইরে থাকার তো আর যৌক্তিকতা নেই। সর্বোপরি যারা সিলেটে আছে তাদেরকে সাবধানে থেকে চলাচলের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন প্রক্টর।