ডিএইচ মামুন, বিশ্বনাথ::সিলেট থেকে হবিগঞ্জ পর্যন্ত অংশেই প্রতিদিনই ঘটছে অগণিত দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছেন শত শত মানুষ। আর পঙ্গুত্বের গ্লানি নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন অনেকে। বিশেষ করে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকার রশিদপুর, নাজির বাজার, জেলার বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর এসব স্থানে গত একবছরে শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর প্রাণ হারিয়েছেন অর্ধশতাধিক। বিশেষ করে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার রশিদপুর যেন এক ডেঞ্জারজোন। মহাসড়কে চলাচলকারী ও স্থানীয়দের কাছে এ বাজার মূর্তিমান আতঙ্কের স্থান। কখন ঘটবে দুর্ঘটনা, কে হারাবে প্রিয়জন তার কোনো দিনক্ষণ নেই।
প্রাণহানি এড়াতে দুর্ঘটনাপ্রবণ রশিদপুর বাজারে গোলচত্বর নির্মাণ করে এ স্থানের দুদিকে সড়ককে প্রশারিত করার দাবি দীর্ঘদিনের। স্থানীয়রা এ দাবি আদায়ে বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত-মৌখিকভাবে বার বার আবেদন করেও কোনো ফল পাননি। কিছুদিন পর পরই রশিদপুর এলাকায় ঘটে দুর্ঘটনা, ঝরে তাজা একাধিক প্রাণ। শুক্রবার বড় দুর্ঘটনার পর দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ।
সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার সকাল ৭টায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রশিদপুর এলাকায় দ্রæতগামী দু’টি যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ৮ জন। আহত অবস্থায় হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন আরও অনেকে।
শুক্রবার সকালে এ দুর্ঘটনার পর আহত ও নিহতদের উদ্ধার করে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতাল এলাকা। মর্গে থাকা নিহতদের স্বজনরা এসে জড়ো হন হাসপাতালের বারান্দায়। কেউ হাসপাতালের বারান্দায় জ্ঞান হারাচ্ছেন আর কেউ বিলাপ করছেন। মহাসড়কে প্রাণ হারানো এমন অগণন মানুষের স্বজনদের বার বার কান্নার সাক্ষী হতে হয় ওসমানী হাসপাতালকে।
শুক্রবার এ দুর্ঘটনার পর ফের আলোচনায় এসেছে সড়কটি। নড়েচড়ে বসেছেন প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা। কিভাবে এসব দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। এমন বাস্তবতায় যানবাহনের বেপরোয়া গতি, অপ্রশস্ত রাস্তা আর ট্রাফিক আইন অমান্য করাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। দুর্ঘটনা এড়াতে দ্রæত ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চারলেনে রূপান্তর এবং হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা বাড়ানোর দাবি স্থানীয়দের। আর ভাঙাচোরা ও ছোট রাস্তার দোষ দিলেও চালকদের অসচেতনতার কথা কিছুটা হলেও স্বীকার করছেন শ্রমিক নেতারা।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, সিলেট বিভাগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ শামসুজ্জামান মানিক বলেন, ‘সাইফুর রহমানের (সাবেক অর্থমন্ত্রী) সময় সড়কটি যে পরিমাণ বড় করা হয়েছিল, এর পর থেকে একইভাবে আছে। দিনে দিনে গাড়ির পরিমাণ কয়েকগুণ বাড়লেও সড়ক আর বড় হয়নি। তাছাড়া সড়কটির অধিকাংশ জায়গায় ভাঙাচোরা আছে। সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। যদিও বড় বড় প্রতিটি পরিবহন তাদের চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, তবুও অসচেতনতা বা অসাবধানতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে।’
হাইওয়ে পুলিশ সিলেট জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ মাসুদ করিম বলেন, ‘আমরা সড়কে নিয়মিত অভিযান চালাই। সিলেট জোন প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৬ মাসে অসংখ্য মামলা হয়েছে। তাছাড়া স্পিডগান ব্যবহার করে বেপরোয়া যানগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু চালকরা কেউ কাউকে সমীহা করতে চায় না। এক গাড়ি অপর গাড়িকে সুযোগ দিতে চায় না। এছাড়া রাতে চালকরা বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আর অসচেতনতাতো আছেই। তারা সুযোগ পেলেই ইচ্ছামতো গাড়ি চালান। এজন্য দুর্ঘটনাগুলো হয়।’
সিলেট জোন প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৬ মাসে প্রতিদিন অন্তত ২টি করে দুর্ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সকলের মধ্যে যেমন সচেতনতা দরকার, তেমনি সড়কটি বড় হওয়া প্রয়োজন। চারলেন হয়ে গেলে দুর্ঘটনা কিছুটা কমে আসবে।’
এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সিলেট বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এখানে একটি বিষয় হচ্ছে- সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক ৬ লেন প্রকল্প অনুমোদন হয়ে যাওয়া আপাতত রশিদপুরে গোলাচত্বর নির্মাণ করা যাবে না। তবে ওই বাজারসহ আশপাশে সড়ক প্রশস্ত করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও সতর্কতামূলক সাইনবোর্ডও স্থাপন করা হবে।
তিনি বলেন, গতকালের দুর্ঘটনা কিন্তু দ্রুত ওভারটেকিংয়ের জন্য হয়েছে। এ জন্য গতিনিরোধক নির্দেশনাও এখানে দেয়া এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ইতিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আটজনের মধ্যে ডা. আল মাহমুদ সাদ ইমরান খান ওরফে রুমেলসহ তিন জনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বাদ আছর জানাজা শেষে মানিক পীর (রহ.) কবরস্থালে রুমেলকে ও ওসমানীনগরের সাদিপুর বাকি দুইজনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
এ দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী ডা. শারমিন আক্তার অন্তরাও গুরুতর আহত হয়েছেন। ডা. অন্তরা বিসিএস প্রিলি পরীক্ষা দিতে সিলেট থেকে এনা পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন স্বামী ডা. ইমরান।
এর আগে শুক্রবার ভোরে রশিদপুরের অদূরবর্তী ব্রিজের কাছে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে আটজন নিহত হন। যাদের মধ্যে রয়েছেন ডা. ইমরান। স্ত্রী ডা. অন্তরার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তিনি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন।
জানা গেছে, সিলেট নগরীর ফাজিলচিশত এলাকার বাসিন্দা প্রখ্যাত প্যাথলজিস্ট অধ্যাপক ডা. আমজাদ হোসেনের ছেলে রুমেল জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি সিলেট নগরের উইমেন্স মেডিকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন। তাদের দুই কন্যা শিশু রয়েছে।
এদিকে ওসমানীনগরের সাদিপুর ইউনিয়নের ধরখা গ্রামে চলছে শোকের মাতম। দুর্ঘটনায় নিহত আটজনের মধ্যে এই গ্রামের দুজন প্রাণ হারান। শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বাদ এশা স্থানীয় আওরঙ্গপুর মাদরাসা প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে ধরখা পঞ্চায়েতি গোরস্তানে তাদের দাফন করা হয়। জানাজার নামাজে হাজরো মুসল্লি অংশ নেন।
এই দুর্ঘটনায় অন্তত ১৮ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন, সিলেটের উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক আল মাহমুদ সাদ ইমরান খান (৩৩), এনা পরিবহনের চালক ওসমানীনগর উপজেলার ধরখা গ্রামের মঞ্জুর আলী (৩৮), সুপারভাইজার সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মিঠাভরা গ্রামের সালমান খান (২৫), হেলপার ধরখা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন (২৪), লন্ডন এক্সপ্রেসের চালক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার রাজানিয়াকান্দি পশ্চিম পাড়ার রুহুল আমিন (৫০), ঢাকার ওয়ারি এলাকার বাসিন্দা কলেজছাত্র নাদিম আহমদ সাগর (১৯), সিলেট নগরের আখালিয়া নায়াবাজার এলাকা শাহ কামাল (৪৫) ও ছাতক উপজেলার বাউয়ালী গ্রামের মফিজ আলীর মেয়ে রহিমা খাতুন (৩০)।