তাহির আহমদ:: আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম । শেষ নবী হচ্ছেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাঁর পরে কোন নবী বা রাসূল এ পৃথিবীতে ধর্ম প্রচার করতে আগমন করবেন না। কিন্তু নবী রাসূলদের অবর্তমানে একটি কালো যুগ-সন্ধিক্ষণে মানুষ যখন ধর্মীয় অনুশাসন ভুলে গিয়ে পাপাচার ও ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় তখনই আল্লাহর পথ দেখানোর জন্য অর্থাৎ হেদায়তের উদ্দেশ্যে আল্লাহর ওলীগণ পৃথিবীতে আগমন করে থাকেন তাদের মধ্যে হলেন মাওলানা শাহ কারামত আলী জৌনপুরী।
মাওলানা শাহ কারামত আলী জৌনপুরী ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দির একজন সমাজ সংস্কারক, হানাফি মাযহাবের অনুসারী ফকিহ ও সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তরিকায়ে মুহাম্মদিস অন্যতম প্রচারক। তিনি ওয়াজ নসীহত করে মানুষকে ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি আহবান করতেন। তিনি মূলত বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ধর্মপ্রচার করেন। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ৪০-এরও বেশি।
জন্ম ও বংশ পরিচয়::
কারামত আলী ভারতের উত্তর প্রদেশের জৌনপুরের মোল্লাটোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবু ইব্রাহিম শেখ মোহাম্মদ ইমাম বখশ। তিনি একজন তাপস ও ধর্মপ্রাণ লোক ছিলেন। তিনি ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিকের বংশধরও ছিলেন। [
১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুন, ১২১৫ হিজরীর ১৮ মুহাররাম জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর তার পিতা তার নাম রেখেছিলেন আলী, কথিত আছে পরবর্তীতে তাঁর কারামত দেখে জনসাধারন তাকে কারামত আলী নামে অভিহিত করে। তাঁর নিজের বইসমূহে নাম লিখতেন ‘আলী জৌনপুরী’ অথবা ‘আলী জৌনপুর মশহুর (খ্যাত) কারামত আলী।
শিক্ষাজীবন::
কারামত আলী জৌনপুরী তার পিতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর মওলানা কুদরতউল্লাহ দৈলভী ও আহমদউল্লাহ র নিকট নিকট হাদিস শরীফ ও অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন। আঠারো বছর বয়সে কারামত আলী জৌনপুরী তাসাউফ (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) শাস্ত্রে আগ্রহী হয়ে তরিকায়ে বেরলভী মুহাম্মদিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন।
কর্মজীবন::
সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত মুজাহিদ। কারামত আলীও তার সাথে জিহাদে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু সাইয়েদ আহমাদ তাকে সশস্ত্র সংগ্রামের বদলে বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ওয়াজ-নসীহত ও লেখনীর মাধ্যমে সমাজ সংস্কার ও ধর্মপ্রচারের নির্দেশ দেন। কারণ তৎকালীন সময়ে এসব অঞ্চলের সাধারণ মুসলমানরা ইসলাম ধর্মের আবশ্যকীয় কার্যক্রম যেমন নামাজ, রোজা ভুলে মূর্তি পূজা সহ নানা অপকর্ম জড়িয়ে পড়েন।
মুর্শিদের নির্দেশে কারামত আলী বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ পুনরূদ্ধারের কাজে লিপ্ত হন।
ইসলামের বিস্তারের লক্ষে তার একান্ন বছরের দাওয়াতী কাজের ফলে প্রায় ১ কোটি মানুষ ইসলামের ছায়াতলে এসেছেন বলে বর্ণিত হয়েছে ।এ দেশের ইসলামি ও আরবী শিক্ষার ক্ষেত্রে তার অনন্য ভূমিকা রয়েছে।
এদেশে আরবি চর্চার ক্ষেত্রে যাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে তাঁদের মধ্যে মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী অন্যতম। তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রচারক ও সমাজ সংস্কারক। তাঁর চল্লিশটি গ্রন্থের মধ্যে দাওয়াত মাস্নূনা দোয়া-কালাম সম্পর্কীয় রচনা। আরবি ও উর্দু ভাষায় এটি রচিত। মুলাখ্খাস ও বরাহীন কাত‘ইয়্যা ফী মওলূদি খায়রিল-বরিয়্যা গ্রন্থদ্বয় মওলূদ সম্পর্কে লিখিত এবং নসীমুল-হরমায়ন গ্রন্থে ইসলামী চিন্তাধারা ও তৎসম্পর্কিত মতবিরোধ আলোচিত হয়েছে।
ভ্রাম্যমাণ মাদ্রসা::
কারামত আলী জৌনপুরীর কর্মজীবনের সিংহভাগ সময় ধর্মীয় প্রচারণামূলক কাজের স্বার্থে বাংলা ও আসাম অঞ্চলে নৌভ্রমণ করতে হতো। এ জন্য তিনি একটি ভ্রাম্যমাণ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদ্রাসাটি ছিল বড় একটি নৌকার মধ্যে। শিক্ষার্থীরা নৌকাতেই থাকতেন, কারামত আলী জৌনপুরী তাদের ব্যয়ভার বহন করতেন এবং নিয়মিত শিক্ষাদান করতেন।
সমকালীন রাজনীতিতে অবস্থান
কারামত আলী হাজী শরীয়তউল্লাহ প্রবর্তিত ফরায়েজি আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। ফারায়েজিরা ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষকে দারূল হরব হওয়ার অজুহাতে জুমা ও ঈদের নামাজ আদায় করত না। পক্ষান্তরে কারামত আলী মনে করতেন ভারতবর্ষ যদিও দারূল ইসলাম নয়, তবে দারূল হরবও নয়। বরং ভারতবর্ষ হচ্ছে দারূল আমান। কারণ ব্রিটিশরা মুসলমানদেরকে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে দেয়। এ বিষয়ে তিনি ফরায়জিদের সাথে বিতর্ক করে তার মত প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
ইন্তেকাল::
ওয়জ নসীহত ও ধর্মপ্রচারের সুবাদে কারামত আলী নেয়াখালী, চট্টগ্রাম, আসাম, রংপুর এবং আরও অনেক প্রতান্ত অঞ্চল সফর করেন। সফরকালীন অবস্থায় ১৮৭৩ সালে রংপুরে তিনি গুরূতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মে তার ইন্তেকাল হয়। রংপুরে মুনশিপাড়া জামে মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
উত্তরসূরী
কারামত আলী জৌনপুরী খলিফার সংখ্যা শতাধিক। তার ১৪ জন সন্তান-সন্তুতি ছিলেন। তাদের মধ্যে দুই ছেলে পরবর্তীতে তার কার্যক্রম অব্যহত রেখে খ্যাতি অর্জন করেন তার মধ্যে অন্যতম হাফিজ আহমদ জৈনপুরী রহ:
রচনাবলী::
কারামত আলী প্রায় ৪৬টি পুস্তক রচনা করেন। তন্মধ্যে মাত্র ১৯ টি পুস্তক তিন খন্ডে
কারামত নামে প্রকাশিত হয়। অন্যান্য পুস্তগোলো বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। তার রচিত যে সকল গ্রন্থ সম্পর্কে জানা যায়, তন্মধ্যে রয়েছে।
মিফতাহুল জান্নাত
জিনাতুল মুসল্লী
জিনাতুল কারী
শোরহে হিন্দি জজরি
কাওকাবে দুররি
তরজমায়ে শামাযেেল তিরমিজি
তরজমায়ে মিশকাত
আকায়েেদ হাককা
তাজকিরাতুল আকায়দ
মফিজুল হরূফ
কাউলুচ্ছাবিত
মাকামিউল মোবতাদিইন
হাক্কুল ইয়াকিন
বয়আত ও তাওবা
কাউলুল আমীন
মুরাদুল মুরীদীন
কাউলুল হক
মেরাতুল হক
ইমতিনানুল কুলূব
মোকাশিফাতে রহমাত
মোলাখ্খাছ
ফরজে আম
হুজ্জাতে কাতেয়া
নুরুল হুদা
যা-দুত্তাকওয়া
কিতাবে এস্তেকাম
নূরুন আলা নূর
রাহাতে রূহ
কুউওয়াতুল ঈমান
ইহকাকুল হক
রাফিকুচ্ছালিকীন
তানবীরূল কুলূব
তাজকিয়াতুন্নেছওয়ান
নাছিমুল হারামাইন
বারাহিনে কাতেয়া
মৌলুদে খায়রূল বারিয়া
কেরমাতুল হারামাইন
কোররাতুল উইউয়ুন
রেসালায়ে ফয়সোলা
ওক্কাজাতুল মোমেনীন
ফতহে বাবে ছবিয়ান
দাওয়াতে মাজনুন।
লেখক:সম্পাদক ও প্রকাশক (সিলেট৭১নিউজ)।
তথ্য সংগ্রহ: শাহ কারামত আলী জৌনপুরী উইকিপিডিয়া