ডেস্ক : বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য৷ গত ২০ নভেম্বর দেশটির সরকারের প্রকাশিত এসংক্রান্ত এক প্রতিবদনে এই উদ্বেগের কথা বলা হয়েছে৷মানবাধিকার প্রতিবেদনে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে বিশ্বের ৩০টি দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপের দেশটি৷
বাংলাদেশে মানবাধিকারের সার্বিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়৷ এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় দেশটিতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব এবং জিডিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগের কথা বলা হয়৷
প্রতিবেদনে স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১৫৮টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমাগত কমছে৷ কোভিড-১৯ বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করায় ৩৮ জন সাংবাদিক এবং স্বাস্থ্যখাতে জড়িত পেশাজীবিসহ চার শতাধিক ব্যক্তিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়েছে৷
প্রতিবেদনে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ ও বিরোধী দলীয় একজন প্রার্থীর ওপর হামলার কথা বলা হয়৷ তাছাড়া নির্বাচন পযবেক্ষণ করায় দেশটিতে অবস্থিত যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোর সমালোচনা করেছে বাংলাদেশ সরকার বলে উল্লেখ করা হয়৷
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করা হলেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইন্টারনেট সেবা সীমিত করে দেওয়ায় সেখানে কোভিড-১৯ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় জনস্বাস্থ্য ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে বলে জানানো হয়৷এই প্রতিবেদন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদনটি পুরোপুরি পড়ার আগে কোনা মন্তব্য করতে রাজি হননি৷
তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম বলেন, ‘‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না৷ আর ডিজিটাল আইনে মামলা কার বিরুদ্ধে কী কারণে হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে না জেনে মন্তব্য করা যাবে না৷ কেউ তো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও অপরাধ করে থাকতে পারেন৷ আমরাও তো ডিজিটাল আইনে মামলা করেছি৷ আমাদের ওয়েবসাইট হ্যাক করে প্রতারকরা চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়েছে৷ তাহলে আমরা কী করব? তবে অহেতুক কারুর বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা গ্রহণযোগ্য নয়৷’’
বাকস্বাধীনতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘বাকস্বাধীনতা যে নেই তা পুরোপুরি বলা যাবেনা৷ তাহলে প্রতিবাদ সমাবেশ, র্যালি- এগুলো কীভাবে হচ্ছে?”`আর্টিকেল ১৯’ এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘‘এই প্রতিবেদনের সাথে আমি আরো যেটা যোগ করতে চাই তা হলো, বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদী ও উগ্রবাদীদের অবস্থান আরো সংহত হচ্ছে৷ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাই সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘করোনায় অনেক অপরাধী মুক্তি পেলেও সাংবাদিক কাজলকে এখনো মুক্তি দেয়া হয়নি৷ আর যেসব প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা তারা স্বাধীনভাবে কাজ করছে না৷ ফলে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না৷ উপ-নির্বাচনের পর একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন যে গত জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে উপ-নির্বাচনের অবস্থা আরো খারাপ৷’’
`আমরা করোনার শুরুতে বলেছিলাম যেসব দেশ স্বৈরতন্ত্রের চর্চা করে তারা এই করোনায় তথ্য গোপন করতে চাইবে৷ বাংলাদেশে তাই ঘটছে,” বলেন তিনি৷আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজ বলেন, ‘‘যে দেশে সংসদ সদস্যরা সংসদে হেট স্পিচ দেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না, সেই সংসদ দিয়ে গণতন্ত্র কতটুকু আসবে তাতো সহজেই বোঝা যায়৷ একজন সংসদ সদস্য সংসদে নারীদের প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য দেয়ার পরও পুরো সংসদ চুপ৷’
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘এখানে বাকস্বাধীনতা ও ভিন্নমতের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে৷ আর গণতন্ত্র হলো পছন্দের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা৷ জনপ্রতিনিধি পছন্দ করে নেয়ার স্বাধীনতাতো প্রশ্নবিদ্ধ৷’’তিনি বলেন, ‘‘মেজর (অব.) সিনহা হত্যার পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আমরা দেখছি না৷ এটা সরকারের সদিচ্ছার অনুধাবন বলেই মনে করতে চাই৷’’
উল্লেখ্য, ব্রিটেনের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত জুলাই মাসে ২০১৯ সালের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ ৩০টি দেশকে চিহ্নিত করে তাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানায় দেশটি৷ সেই পর্যালোচনা অব্যাহত রেখে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসের চিত্র তুলে ধরা হয় ২০ নভেম্বরের প্রতিবেদনে৷
লম্বা হচ্ছে গুমের তালিকা
নয় বছরে পাঁচশ
আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস বলছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদশে মোট ৫০৭ জন নিখোঁজ হয়৷ এর মধ্যে ফিরে এসেছে ২৮৬ জন, মারা গেছে ৬২ জন আর এখনো নিখোঁজ রয়েছে ১৫৯ জন৷
ঘটছে প্রতি বছরই
আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট নিখোঁজের সংখ্যা ৩৪৪ জন৷ এর মধে, ২০১৩ সালে ৩৩ জন, ২০১৪ সালে ৮৮ জন, ২০১৫ সালে ৫৫ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৬০ জন, এবং ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মোট ১০ জন নিখোঁজ হয়৷
নিখোঁজের তালিকায় সাংবাদিকও
গত কয়েকবছরে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে৷ সর্বশেষ মোহনা টেলিভিশনের সাংবাদিক মুশফিকুর রহমান গত ৩ আগস্ট নিখাঁজ হন৷ তবে কিছুদিন পর ফিরে আসেন তিনি৷
কারা শিকার?
আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস তাদের বিবৃতিতে বলছে গুম হওয়া ব্যাক্তিদের অধিকাংশই সরকার বিরোধি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিল৷ তবে গুম হয়ে যারা ফিরে এসেছেন, তাঁরাও গুম হওয়ার বিষয়ে নীরবতা পালন করছে বলে দাবি করেছে সংগঠনটি৷
কি বলছে সরকার?
বিভিন্ন সময়ে গুমের/নিখোঁজের বিষয়টি অস্বীকার করে আসলেও, চলতি মাসে জাতিসংঘের কমিটি অ্যাগেইন্সট টর্চারের ৬৭তম সভায় বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে তোপের মুখে পড়ে আইন মন্ত্রী আনিসুল হক৷ সে সময় বাংলাদেশে গুমের ঘটনার কথা তিনি স্বীকার করলেও তা অত বেশি নয় বলে জানান৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে