কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী এ মহাবিশ্বে আল্লাহই প্রাণের সৃষ্টি করেছেন। বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত মহাবিশ্বে প্রাণ সৃষ্টির কনক্রিট কোন তত্ত্ব উপস্থাপন করতে পারেননি। চার্লস ডারউইনসহ বহু বিজ্ঞানী ধারনা করছেন যে, পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই এ গ্রহে এককোষী এমিবার সৃষ্টি হয়। আর তা থেকেই লক্ষ কোটি বৎসরের এলোমেলো প্রাকৃতিক বিবর্তনে প্রাণীজগতের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সেই এমিবার কোন ফসিল বা প্রমাণ কিছুই নেই। এটা কেবলই একটা ধারনা বা বিশ্বাস। প্রাকৃতিক নির্বাচন ও এলোমেলো বিবর্তনের বিষয়টাও্ সে ইতিহাসের ধারনামাত্র। কিছু ফসিল আর কাল্পনিক চিত্র দিয়ে বিবর্তনবাদকে ব্যাখ্যা করা হয়। কাজেই এটাকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে ফেলা যায় না। প্রজাতির মধ্যে কাছাকাছি ডিএনএ হলেই ঐ প্রজাতি থেকে অপর প্রজাতি সৃষ্টির ধারনাও বিজ্ঞান সম্মত নয়। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, কোরআনে বিবর্তনকে অস্বীকার করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনায় যাব। কোরআন, বাইবেল, বিজ্ঞান- সবখানেই এটা স্বীকৃত যে, পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টির পরে শেষ ধাপে মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। বাইবেলের মত মানব সৃষ্টির ধারাবাহিক কোন কাহিনী কোরআনে নেই। যদিও মুসলমানদের মধ্যে বাইবেলের কাহিনীটিই ঘুরে ফিরে প্রচারনা পেয়ে আসছে। কোরআনে আদম সৃষ্টির বেশ কিছু আয়াত আছে। তবে মানব সৃষ্টির উপাদান হিসাবে পানি, মাটির কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি বীর্য ও পর্যায়ক্রমিকতার কথাও বলা হয়েছে। আল্লাহ সরাসরি ‘অলৌকিকভাবে’ মানব সৃষ্টির কথা বলেননি। কোরআনের সুরা নূহ-এ বলা হয়েছে,
‘আর তিনি তোমাদেরকে মাটি হতে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি করেছেন।’ সুরা নূহ: ১৭।
‘অথচ তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে’ । সুরা নুহ : ১৪ [ বিবর্তনবাদকে ডিফেন্ড করার জন্যে অনেকে এ আয়াতটি ব্যবহার করেন। অথচ এটা যে ডারউইনীয়-ডকিন্সীয় বিবর্তনবাদ নয়, তা বোঝা উচিত।
কোরআনের দৃষ্টিতে মানব সৃষ্টি এক অনন্য সৃষ্টি। আল্লাহ মানব সৃষ্টির সাথে সাথে শয়তান সৃষ্টির কথাও বলেছেন। একথা বলাই বাহুল্য যে, কোরআনের অনেক বক্তবই এসেছে রূপক অর্থে। মানব সমাজকে শয়তান থেকে বেঁচে থাকার পথও আল্লাহ বাতলে দিয়েছেন। দিয়েছেন সার্বিক পথের দিশা। কোরআন বলছে, আল্লাহ যখন তার প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলেন তখন ফেরেস্তারা আদমের হানাহানির আশঙ্কা করেছিলেন। তথাপি আল্লাহ আদম সৃজন করলেন এবং ফেরেস্তাদের উপরে তার মর্যাদা নির্ধারণ করলেন। ফেরেস্তাদের মধ্যে ইবলিশ আল্লাহর আদেশ অমান্য করে মানব জাতীর জন্যে অশুভ শক্তিতে পরিণত হলো। যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করবে এবং আল্লাহর বাতলে দেয়া পথে চলবে তারা পুরস্কৃত হবে, যারা করবে না তারা ভোগ করতে থাকবে অনন্ত শাস্তি। আল্লাহপাক কোরআনে নানা রূপক-এ মানবজাতিকে একথাই বুঝিয়েছেন।
মানব সৃষ্টি মাটি, পানি আর বীর্য থেকে, আর শয়তানের সৃষ্টি আগুন থেকে। এর দ্বারা আল্লাহ বোঝালেন, শয়তান যদিও শক্তিশালী, তথাপি মানবের মর্যাদা অনেক বেশী। শয়তান আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছে, যারা শয়তানের অনুসারী হবে, সংশয়বাদী হবে, তারা পরকালে শাস্তি ভোগ করবে। আল্লাহর সৃষ্ট মানবও ভুল করেছে। আল্লাহর আদেশ তারাও অমান্য করেছে। পৃথিবীতে মানুষের আগমন ঘটেছে, আর এই পৃথিবীই মানুষের জন্যে পরীক্ষাগার।
আসুন কোরআনের আয়াতগুলো দেখি:
আল্লাহ্ সকল প্রকার প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে। তাদের কতক বুকে ভয় দিয়ে চলে, কতক দুই পায়ে ভর দিয়ে চলে এবং কতক চার পায়ে ভর দিয়ে চলে; আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম। (২৪ : ৪৫)
‘তিনি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে চলার পথ করেছেন, তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন এবং তা দ্বারা জোড়ায় জোড়ায় বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছেন।’ সূরা ত্বহা- আয়াত নং-৫৩
আমি কি তোমাদেরকে তুচ্ছ পানি থেকে সৃষ্টি করিনি ? (সূরা মুরসালাত-আয়াত নং-২০ )
অতঃপর আমি তা রেখেছি সংরক্ষিত আধারে। (সূরা মুরসালাত-আয়াত নং-২১ )
এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত। (সূরা মুরসালাত-আয়াত নং-২২ )
অতঃপর আমি পরিমিত আকারে সৃষ্টি করেছি, আমি কত নিপুণ স্রষ্টা। (সূরা মুরসালাত-আয়াত নং-২৩ )
তিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এবং কাদামাটি হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। (সূরা সিজদাহ্-আয়াত নং-৭)
অতঃপর তিনি তার বংশধারা বা ভিত্তি স্থাপন করেছেন তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে। (সূরা সিজদাহ্-আয়াত নং-৮)
অতঃপর তিনি ওকে সুষম করেছেন এবং তাঁর নিকট হতে ওতে রূহ (প্রাণ) সঞ্চার করেছেন এবং পরিগঠন করেছেন তোমাদের কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরন। তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা সিজদাহ্-আয়াত নং-৯)
নিশ্চয় এমন কিছু কাল অতিবাহিত হয়েছে- যখন মানবসত্তা উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। সূরা দাহর-আয়াত নং-১
আমি তো মানুষকে সংমিশ্রিত পরিচ্ছন্ন পানির বা তরল পদার্থের বাছাইকৃত বা পরিবর্তিত অতি সামান্য অংশ থেকে সৃষ্টি করে তাকে পরিগঠন করেছি শ্রবণ ও দর্শনকারী রূপে। সূরা দাহর-আয়াত নং-২
তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্টত্ব আশা করছ না। সূরা নূহ- আয়াত নং- ১৩,
‘আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকা হতে, তারপর বীর্য হতে, তারপর আলাকা হতে, অতঃপর পূর্ণাকৃতি অথবা অপূর্ণাকৃতি মাংসপিন্ড হতে।’ সুরা হ্জ্জ: ৫।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানব সমাজ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি (আদম) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনী (হাওয়া) কে সৃষ্টি করেছেন, আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের কাছে যাও এবং আত্মীয়স্বজনদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।’ (আল কোরআন, ৪:১)।
“হে মানব সকল! আমরা তোমাদের সকলকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি এ কারণে যে, তোমরা যেন একে অপরকে চিনতে পার (এবং বুঝতে পার বংশ ও গোত্র কোন গর্বের বিষয় নয়)। তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহ কাছে অধিক উত্তম যে অন্যের থেকে বেশী তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ জ্ঞানী এবং মানুষের ভাল ও মন্দ কাজের বিষয়ে সম্যক অবগত আছেন” (হুজুরাত : ১৩)।
‘হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন, আর বিন্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। (নিসা ১)।
সূরা অন‘আম এর ৯৮ আয়াতে ,
‘তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অনন্তর একটি হচ্ছে তোমাদের স্থায়ী ঠিকানা ও একটি হচ্ছে স্বল্প মেয়াদী ঠিকানা। নিশ্চয়ই আমি প্রমাণাদি বর্ণনা করে দিয়েছি বিস্তারিতভাবে তাদের জন্যে, যারা চিন্তা করে’।
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহ পরম সন্তুষ্টির বাণী হচ্ছে, ‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে’ (ত্বীন ৪)।
আল-কুরআনে বর্ণিত মানব সৃষ্টির উপাদান সমূহ, ‘কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা (সাজদাহ ৩২/৭), তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে। [৩২:৮], পঁচা কাদা থেকে তৈরী বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি (হিজর ১৫/২৬), এঁটেল মাটি (ছাফ্ফাত ৩৭/১১), পোড়া মাটির ন্যায় শুষ্ক মাটি (আর-রহমান ৫৫/১৪)। আল্লাহ নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫) এবং তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭২) আদম মাটি (অজৈব পদার্থ) থেকে সৃষ্টি, বাকী সবাই পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট’ (সাজদাহ ৩২/৭-৯)। আদম মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি। ‘অতঃপর তিনি তার থেকে তার যুগল সৃষ্টি করেছেন’ (যুমার ৩৯/৬)। আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত নারী-পুরুষ’ (নিসা ৪/১)। কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রাণী সৃষ্টিতে পানি এবং পানি বাহিত উপাদানলোকে ব্যবহার করা হয়েছে (২১ : ৩০), আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ এবং তা দ্বারা জোড়ায় জোড়ায় বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন (২০ : ৫৩), উদ্ভিদ জগৎ সৃষ্টির ক্ষেত্রে আকাশ থেকে বর্ষিত পানি (২৪ : ৪৫)। একদা অণুজীব সৃষ্টির মত উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে উঠলে আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ও পরিবেশে (৭৭:২১) সংরক্ষিত কোন স্থানে বা আধারে জীবন সৃষ্টির এই উপকরণগুলোকে একটি (৭৭:২২) নির্দিষ্টকাল ব্যাপী প্রক্রিয়াজাত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে।
আল-কোরআনে ‘রুহ’ অর্থাৎ প্রাণের কথা বলা হয়েছে। সূরা বনি ইসরাঈল-এ বলা হয়েছে, তোমাকে ওরা রূহ্ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, রূহ্ (জীবন/গায়েবী শক্তি) আমার প্রতিপালকের আদেশঘটিত। এ বিষয়ে তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দেয়া হয়েছে। (১৭:৮৫)
আদম-এর পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে মা হাওয়া তথা নারী সৃষ্টির কোন কথা কোরআনে বলা নেই। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নারী চরিত্রের রূপক হিসাবে ‘নারী জাতিকে পাঁজরের বাঁকা হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড়ের মধ্যে একেবারে উপরের হাড়টি অধিক বাঁকা। যদি তা সোজা করতে যাও, ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি তা ছেড়ে দাও, তবে সব সময় বাকাই থাকবে। সূতরাং তোমরা নারীদের সাথে উত্তম ও উপদেশমূলক কথাবার্তা বলবে’ মর্মে হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে।
আল-কোরআনের (৩২:৮, ৯), (৭৬:১, ২), (৭৭:২০- ২৩) নং আয়াতে প্রদত্ত তথ্যগুলো জীবন সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থার সাথে যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ, তেমনি প্রাণী তথা মানবদেহের প্রজনন তন্ত্রে জীবন সৃষ্টির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
(২১ : ৩০), (২০ : ৫৩) ও (২৪ : ৪৫) নং আয়াতে ‘মা’ এর আভিধানিক অর্থ ‘পানি’। এখানে সরাসরি পানির কথা বলে প্রথমত এই ইংগিত দেয়া হয়েছে যে, প্রাণবান সবকিছু সৃষ্টির জন্য পানি অপরিহার্য উপাদান। (২০ : ৫৩) নং আয়াত থেকে ধারনা পাওয়া গেল যে, জীবন সৃষ্টির জন্য আকাশ থেকে বর্ষিত পানি ব্যবহৃত হয়েছে।
কোরআনের উপরোক্ত আয়াতসমূহ বিশ্লেষন করলে এটা সুষ্পষ্ট যে, হঠাৎ করে বা অলৌকিকভাবে প্রাণ সৃষ্টি হয়নি। এ গ্রহের উপাদান দিয়েই পর্যায়ক্রমে আদম তথা মানবের সৃষ্টি। কত সময় ব্যয়ে মানব ও প্রাণীজগতের সৃষ্টি হয়েছে তা কোরআনে স্পষ্ট করা হয়নি। আবার পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের স্বীকৃতিও কোরআনে আছে।
কোরআনের কথা বিশ্বাস করা না করার স্বাধীনতা মানুষের আছে। আল্লাহ বলেন, আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ কোরআনকে বিশ্বাস করবে এবং কেউ কেউ বিশ্বাস করবে না। বস্তুতঃ তোমার পরওয়ারদেগার যথার্থই জানেন দুরাচারদিগকে। (৩১: ৪০)