সীমান্তের ওপারে কুলিয়ান খাসিয়াপুঞ্জিতে আব্দুর রহিম ও তার সহযোগীদের নিকট হস্তান্তরের সময় ২০ লাখ টাকার অফার দেন সাময়িক বরখাস্তকৃত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া। আকবর বার বার বলছিলেন, ২০ লাখ টাকা দেব। আমাকে ছেড়ে দেন ভাই। কিন্তু আকবরের এই অফারে রাজি হননি আব্দুর রহিম ও তার সহযোগীরা। তারা আকবরকে বেঁধে নিয়ে আসেন। আকবরের এই অফারের বিষয়টি জানিয়ে আব্দুর রহিম বলেন, আমরা বলেছি তুমি তো দেশের শত্রু। তোমারে বাঁচাইয়া রাখা যাবে না। আকবর হোসেন ভূঁইয়া গ্রেফতারের ঘটনা নিয়ে সর্বত্র চলছে নানাভাবে আলোচনা। আব্দুর রহিম নিজ উদ্যোগে আটকের কথা বললেও স্থানীয়রা বলছেন ভিন্ন কথা। স্থানীয় শাহাব উদ্দিন ও সালেহ আহমদ জানিয়েছেন, সীমান্তের ওপার থেকে আকবরকে নিয়ে আসার জন্যেই ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে আব্দুর রহিমকে পাঠানো হয়। এজন্যে সে সেখানে গিয়ে মোবাইলেও কথা বলেছে। সে মোবাইলে বলে ‘সালেহ আহমদ নি। ওসি স্যারকে বলিও তারে পাইলিছি।’
আকবরকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে ধূম্রজাল সৃষ্টি হলেও বিভিন্ন সূত্র বলেছে, কৌশলেই তাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাপার হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে জনসম্মুখেও কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি।
সূত্র মতে, রায়হান আহমদকে হত্যার পর সিলেটবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। ঘটনার ৩ দিন পরই আকবর পালিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যান। প্রথমে খাসিয়া অঞ্চলে অবস্থান করলেও পরে চলে যান মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে। সেখানে হোটেলে অবস্থানও করেন। বেশভুষাও পাল্টে ফেলেন। ‘কুমার দেব’ নাম ধারণ করে নিজেকে খাসিয়া বানানোরও আপ্রাণ চেষ্টা করেন। শিলং থেকে চলে আসেন আসামের শিলচরে। এখান থেকে পরে যান করিমগঞ্জের বদরপুরে। এই বদরপুরে ২ দিন থাকার পরই তিনি মেঘালয়ের খাসিয়াপুঞ্জি হয়ে কানাইঘাটের দনা সীমান্তের খাসিয়াপুঞ্জিতে আসেন।
সূত্র আরো জানায়, শিলচর থেকে আকবরকে গৌহাটি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এক ব্যক্তি আকবরকে সীমান্তের ওপারের খাসিয়াপুঞ্জিতে নিয়ে আসেন। প্রথমে টের না পেলেও পরে বুঝতে পারেন তিনি জালে আটকা পড়েছেন। রাত ৪টায় খাসিয়াপুঞ্জির হেডম্যানের নিকট তাকে হস্তান্তর করা হয়। বিষয়টি সীমান্তবর্তী এলাকার প্রশাসনকে জানানো হলে তাকে নিয়ে আসতে নানান কৌশল অবলম্বন করা হয়। সোমবার দুপুরে ওপার থেকে নিয়ে আসা হয় আকবরকে।
অন্য একটি সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারা নানা কৌশলে সোর্সের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনেন আকবরকে। এজন্যে সীমান্ত এলাকার ব্যাপারে অধিক জানাশোনা রয়েছে এমন লোকদের কাজে লাগায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সীমান্তবর্তী দনাছড়া গ্রামের মৃত তরফ আলীর পুত্র আব্দুর রহিম বিভিন্ন মাধ্যমকে জানান, তার এক ভাগ্নে শিলচর থেকে আকবরকে ধরে নিয়ে আসেন। এটি তার নিজের ইচ্ছায় করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত কানাইঘাটের ওসিকে জানিয়ে আকবরকে নিয়ে আসেন। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আব্দুর রহিম মোবাইলে কথোপকথনের এক পর্যায়ে বলছেন,‘সালেহ নি। ওসি স্যারকে বলিও তারে পাইলিছি। আমি তারে নিয়া আইরাম।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আব্দুর রহিম, শাহাব উদ্দিন ও সালেহ আহমদ সোমবার সকালে একই সাথে ছিলেন। পুলিশের সাথে তাদের কয়েক দফা কথাও হয়। শাহাব উদ্দিন গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিলেটের ডাককে জানান, সোমবার সকালে কানাইঘাট থানার ওসি শামুসোদ্দোহা পিপিএম আমাদেরকে থানায় ডেকে নেন। ওপারে আকবরকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে দেশে নিয়ে আসতে সহযোগিতা চাইলে তিনি ও সালেহ আহমদ বিষয়টি দেখছেন বলে তাকে জানান। এরপর আব্দুর রহিমকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ওপারে পাঠানো হয়। তার সাথে আরও ৫ জন ছিলেন। তারা সকলে মিলেই আকবরকে ১১ টার দিকে সীমান্তের অভ্যন্তরে নিয়ে আসেন। ১৩৩৫ নম্বর পিলারের নিকট শাহাব ও সালেহ দাঁড়িয়েছিলেন বলে শাহাব উদ্দিন নিজেই সিলেটের ডাককে বলেছেন। তিনি ভিডিও কথোপকথনের বিষয়টিও উল্লেখ করেন। সালেহ আহমদও একই তথ্য জানিয়েছেন। আকবরকে সীমান্তবর্তী খাসিয়াপুঞ্জিতে নিয়ে আসার বিষয়টি জানালেও কোথা থেকে তাকে আটক করে খাসিয়াপুঞ্জিতে নিয়ে আসা হয়েছে তা তারা বলতে পারেননি। তারা জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টি সিলেটের পুলিশ সুপার, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জের ওসি বলতে পারবেন। আকবর আটকের পর পুলিশ সুপার প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, পুলিশের কিছু বিশ্বস্ত বন্ধু আকবরকে গ্রেফতারে সহযোগিতা করেন। আব্দুর রহিমসহ উল্লেখিত ৩ জনকেই পুলিশের সেই বিশ্বস্ত বন্ধু বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, আব্দুর রহিম এলাকার পরিচিত মুখ। অন্য দুজনও সীমান্ত এলাকা দিয়ে নিয়ে আসা গরু ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত। তবে শাহাব উদ্দিন ও সালেহ আহমদ গরু ব্যবসার বিষয়টি অস্বীকার করেন। আব্দুর রহিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করলেও সিলেটের ডাক’র পরিচয় দিতেই কল বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে একাধিকবার চেষ্টা করেও তার মোবাইলে সংযোগ পাওয়া যায়নি। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন কর্মকর্তাই কোন কথা বলতে চাননি।
তবে সিলেটের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, আকবর হয়তো সীমান্ত দিয়ে যেতে চেয়েছিল কিংবা সীমান্ত হয়ে দেশে ফিরতে চেয়েছিল। পুলিশের কিছু বন্ধুর সহযোগিতায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পেরেছে। এজন্যে স্থানীয়দের প্রতি তিনি ধন্যবাদও জানান।