Please Share This Post in Your Social Media
করোনা পৃথিবীতে দৃশ্যমান হওয়ার পর থেকে প্রায় ১০ মাস চলে গেল। কিন্তু এখনো এর কোনো প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কার করা যায়নি। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়াসহ অনেক দেশের গবেষণা সংস্থাগুলো প্রথমে গত জুন-জুলাই মাসের মধ্যেই টিকা আবিষ্কারের ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু পরে জানানো হলো অক্টোবরের মধ্যে।
কিন্তু সর্বশেষ গত ২৯ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্টনি ফাউসি বলেছেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে করোনা ভাইরাসের নিরাপদ ও কার্যকর টিকার প্রথম ডোজ ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির শুরু থেকে পাবেন। তবে এই কথার ওপরও বিশ্বাস রাখা যাচ্ছে না। টিকা চূড়ান্তভাবে বাজারে না আসা পর্যন্ত, এসব কথার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছে না বিশ্ব। এদিকে টিকার ব্যবসা নিয়েও বিশ্ব রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়েছে। তবে বিশ্ব রাজনীতি যাই হোক, করোনার টিকা আসাটাই এখন বড় ব্যাপার।
করোনায় বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে ধরাশায়ী হয়ে পড়েছে, বাংলাদেশ সেখানে ব্যতিক্রম। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন আজ সারা বিশ্বের চোখে পড়েছে। বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল। করোনার সময়ও বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী। শেয়ারবাজার করোনার পরে অনেক ভালো হয়েছে, রপ্তানিও বেড়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো যখন জিডিপি মাইনাসে যাচ্ছে, সে সময় বাংলাদেশ ৭ শতাংশ জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ৭ শতাংশ না হলেও বাংলাদেশের জিডিপি চলতি অর্থবছরে ৪-৫ শতাংশ থাকবে। আমরা এই অর্জনকে উদযাপন করতে পারি। সরকার উন্নয়ন দিবস পালন করতে পারে। এতে করে আমাদের উন্নয়ন সম্পর্কে বিশ্বের মানুষ জানতে পারবে।
শীতের আগেই করোনার টিকার আশা করেছিল বিশ্ববাসী। সেই আশা আর পূরণ হলো না। তাই করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা নিয়ে সারা বিশ্ব বেশ চিন্তায়। শীতপ্রধান দেশগুলোর মানুষ ইতোমধ্যেই আবারো করোনা মোকাবিলায় বড় ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ লকডাউন ঘোষণা করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েকমাস আগে থেকেই বলে আসছে, শীতের সময় করোনা আবার আগের মতোই হানা দেবে। তাই বিশ্ববাসীকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। গত কয়েকদিন থেকেই করোনায় মানুষের আক্রান্তের হার রেকর্ড পরিমাণে বাড়ছে।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্য অনুযায়ী, করোনা ভাইরাস আক্রান্তের শুরুর পর গত ২৮ অক্টোবর রেকর্ড পরিমাণ পাঁচ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়। গত শুক্রবার একদিনে যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ এক হাজার ৪৬১ জন, মৃত্যু হয়েছে ৯৮৮ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৪১ হাজার ১৬৭ জন।
এটা আমাদের জন্য একটা নতুন সংকেত। কারণ ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় ইতোমধ্যেই শীতের প্রকোপ শুরু হয়েছে। শীতের শুরুতেই যদি এভাবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণ বাড়তে থাকে তাহলে আগামী ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়টা কতটা খারাপ যাবে, তা অনেকটা আন্দাজ করা যায়।
ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত চার কোটি ৯৬ লাখ ৬১ হাজার ২২২ জন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তার মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন তিন কোটি ৩৩ লাখ ৭৯ হজাার ৮০১ জন। আর মৃত্যুবরণ করেছেন ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৬৭২ জন।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল গত ৮ মার্চ, তা চার লাখ পেরিয়ে যায় ২৬ অক্টোবর। এর মধ্যে গত ২ জুলাই চার হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। ধীরে ধীরে সংক্রমণের হার এক হাজারের মধ্যে নেমে আসে। তারপর গরম কিছুটা কমতে শুরু করলেই বাংলাদেশেও করোনা রোগীও বাড়তে থাকে। তবে বাংলাদেশের মানুষের পরীক্ষা করার আগ্রহ কম এবং সুবিধাও কম থাকায় পরীক্ষা কম হচ্ছে। তাই করোনার বাস্তব চিত্র পাওয়টা কঠিন। তবে বাংলাদেশে করোনা যে অনেকটা কমে গিয়েছিল, সেটা ঠিক। তবে কিছুদিন থেকে সেটা আবার ধীরে ধীরে বাড়ছে।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে করোনা রোগী বৃদ্ধির সংখ্যা পরিষ্কার হবে। গত ১২ অক্টোবর বাংলাদেশে করোনা রোগী ছিল ১১৯৩ জন। ২৫ অক্টোবর সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০৮ এবং ২৮ অক্টোবর ১৪৯৩ জন। ২৯ অক্টোবরে ১৬৮১ এবং ৩০ অক্টোবর ১৬০৪ জন করোনায় আক্রান্ত হন এবং সর্বশেষ মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) ১৭৩৬ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন পাঁচ হাজার ৯৬৬ জন।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আসন্ন শীতে আসতে পারে বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছুদিন ধরে বলে আসছেন। সরকার ইতোমধ্যেই বেশ কিছু পরিকল্পনাও নিয়েছে। শীতে করোনা আবার বেড়ে গেলে কীভাবে সামাল দেওয়া হবে, সে বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে আগাম প্রস্তুত থাকার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন।
তবে গত মার্চ মাস থেকে তিন মাস বাংলাদেশ যেভাবে সবকিছু বন্ধ করে রেখেছিল, সেভাবে হয়তো আর বন্ধ রাখা হবে না। তবে উন্নত বিশ্ব কিন্তু আবারো সেই লকডাউনের দিকেই যাচ্ছে। শীতে বেশি বাড়লে তারা হয়তো পুরোপুরি লকডাউনে যাবে। কারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে আগে। বাংলাদেশে এখন শীতের আভাস দিতে শুরু করেছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শীত এসে যাবে। আর তখনই আমাদের জন্য করোনা কি ধরনের সংকট তৈরি করবে তা নিয়েই চিন্তার বিষয়।
করোনাকালীন সরকার ও প্রাইভেট সেক্টর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক সঙ্গে কাজ করার কারণে করোনা সংকট আমরা অনেকটা মোকাবিলা করতে পেরেছি। তবে আমাদের অনেক মানুষকে আমরা করনোয় হারিয়েছি। তাই করোনা নিয়ে শীতে যে সংকটের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তা মোকাবিলায় আমরা সাত দিনের জন্য পুরো লকডাউনে যেতে পারি। এই সাতদিন মানুষ জরুরি কাজ ছাড়া বাসার বাইরে বের হবে না। আর যারা অসুস্থবোধ করবে, তারা হাসপাতালে ফোন করবে, হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স গিয়ে তাদের নিয়ে আসবে। করোনার টেস্টের প্রয়োজন হলে টেস্ট করাবে। এই সাতদিন প্রয়োজনে প্রতিদিন লাখেরও বেশি মানুষকে পরীক্ষা করাতে হবে। যারাই করোনা পজিটিভ হবে, তাদের আলাদা করে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। সাতদিনের ২৪ ঘণ্টা এই সার্ভিস চালু থাকবে। এতে করে করোনা ছড়িয়ে পড়া রোধ করা অনেকটাই সম্ভব।
আগামী ১-৭ ডিসেম্বর আমরা এই পুরো লকডাউন বাস্তবায়ন করতে পারি। এতে করে যে সাতদিন কার্যক্রম বন্ধ থাকবে, তা পরবর্তী সাত সপ্তাহের সাতটি শনিবার সরকারি-বেসরকারি সকল কার্যক্রম চালু রেখে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। এতে করে আমাদের অর্থনীতির কোনো ক্ষতিই হবে না।
শীতের মধ্যে করোনা বেড়ে গেলে সংক্রমণ রোধে সাত দিনের জন্য লকডাউনের কোনো বিকল্প থাকবে না। সরকারকে আগাম ঘোষণা দিয়েই এই লকডাউন করতে হবে। এতে করে মানুষ সাতদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখবে।
সরকার এখন করোনা টেস্ট ফ্রি করে দিতে পারে। টেস্ট ফ্রি করলে সরকারের তেমন কোনো ব্যয় বাড়বে না। এখন মানুষ আর আগের মতো অহেতুক টেস্ট করবে না। এখন অসুস্থ হলেই মানুষ টেস্ট করতে চায় না। তাই এটা ফ্রি করে দিতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো- বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের বিদেশে বহির্গমন ও আগমনে স্থল ও বিমানবন্দরগুলোতে পিসিআর ল্যাবের মাধ্যমে করোনা পরীক্ষা করে ৩০ মিনিট থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এখন এসব উন্নত মেশিন পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের নয়াদিল্লিতে মাত্র ৩০ মিনিটে আগমনী যাত্রীদের করোনা টেস্টের রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে এবং তা সরকারের খরচে করা হচ্ছে। যাত্রীকে কোনো টাকা দিতে হচ্ছে না। দুবাইয়ে কোনো যাত্রী নামলে তার ফোন নম্বর ও ঠিকানা রেখে দেওয়া হয়, আর করোনা টেস্টের স্যাম্পল নেওয়া হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই ব্যক্তি তার নির্দিষ্ট ঠিকানা ছাড়া কোথাও যেতে পারবেন না। এই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে করোনার টেস্টের রিপোর্ট সেই ব্যক্তির ইমেইল এবং ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়। নেগেটিভ হলে তিনি তার কাজে যাবেন, আর পজিটিভ হলে আইসোলেশনে থাকবেন।
গোলাম মোস্তফা
চেয়ারম্যান, দেশবন্ধু গ্রুপ
Related