নোমান বিন আরমান::এখন থেকে দু’বছর পর, ২০২২ সালে ফ্রান্সের ক্ষমতায় থাকবে মুসলিমরা। মুসলিমরাই শাসন করবে ইউরোপের সমৃদ্ধশালী এই দেশটি। মুসলিমদের শাসনের ফলে কমে গেছে বেকারত্বের হার। প্যারিস হয়েছে অপরাধমুক্ত নগর। এমনটা হলে আপনার কেমন লাগবে?
আপনার যেমনই লাগুক। ফ্রান্সের এমন ‘বাস্তবত’ অবস্থার কথা ‘স্থিরভাবে’ বলছেন দেশটির জীবিত লেখকদের মধ্যে সবচে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক মিশেল হুয়েলবেক। ২০১৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘সুমিশন’ (ইংরেজীতে সাবমিশন) তিনি ফ্রান্সের যে চিত্র এঁকেছেন সেটি বিবিসির ভাষায় এমন :-
‘ফ্রান্সে ইসলামী শাসন কায়েম হয়েছে। মেয়েরা বোরকা পরছে, বহুবিবাহ বৈধ করা হয়েছে, আর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হচ্ছে কুরআন।’
এই উপন্যাস নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। সাহিত্যের ছদ্মবেশে ‘ইসলামবিরোধী ভীতি ছড়ানো’র অভিযোগ ওঠে মিশেলের বিরুদ্ধে। ইসলাম নিয়ে পূর্বে বিতর্কিত মন্তব্য করা এই ঔপন্যাসিক এর জবাবে যা বলছেছেন, তা বিবিসি থেকে পড়তে পারেন।
‘‘একটি মুসলিম পার্টি ফ্রান্সের রাজনীতি বদলে দিতে পারে এমন সম্ভাবনা সত্যি আছে। লা ফিগারো-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেছেন, সারা পৃথিবীতেই ধর্মের পুনরুত্থান ঘটছে, নাস্তিকতা বড় বেশি বিষণ্ণ।
“আমি নিজেও এখন আর নাস্তিক নই এবং আলোকিত মানুষের শূন্যতার চাইতে ইসলামও ভালো”
হুয়েলবেকের কথায়, “কুরআন আবার পড়ার পর আমার মনে হয়েছে – এটা আমি যা ভেবেছিলাম তার চাইতে ভালো। সব ধর্মের মতোই এতেও ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে, সাধারণভাবে কুরআনে আক্রমণাত্মক ধর্মযুদ্ধের চাইতে একাকী প্রার্থনাকেই উৎসাহিত করা হয়েছে।” “তাই আমি কোন ভয় থেকে এই উপন্যাস লিখেছি বলে মনে হয় না।” বলেন মিশেল হুয়েলবেক।
মিশেলের এই সাফাই তাঁর ‘আন্তরিকতা’ মেনে নিলেও ফ্রান্সসহ সারাবিশ্বে চলমান ইসলামোফোবিয়া থেকে মুক্ত, এবং প্রোপাগাণ্ডার নতুন তরিকা নয়, সেটি হলফ করে বলা যায় না।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সেই সব চে’ বেশি মুসলিমের বসবাস। ২০১৬ সালের হিসাব মতেই সেটা ৫৭ লাখ ২০ হাজার। ধর্মেবিশ্বাসী হিসেবে দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায় মুসলিম। এই সংখ্যাটাই তাদের ভীতির আসল কারণ।
এ জন্যই ফ্রান্স মুসলিম কার্ড খেলছে। এই খেলাটা খুব স্বাভাবিক। সামান্য হিজাবের জন্য খুন সভ্য ফ্রান্সে খুব সাধারণ ঘটনা। এমনকি আদালতে বিচারকের এজলাসেও নারীদের হিজাবের প্রাণ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ফ্রান্সের সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিনোদন ও পত্রপত্রিকায় ইসলাম ও নবীবিদ্বেষ প্রায় নিত্য ব্যাপার।
প্যারিস টাওয়ারে দুজন মুসলিম নারী আক্রান্ত (যদিও এঘটনায় কোনো বিচার হয়নি) ও এর আগে বিদ্বেষী কার্টুন প্রদর্শনের ‘অভিযোগে’ শিক্ষক নিহত (একারণে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদান) হামলাকারীকে হত্যার আগে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁর একটি মন্তব্যে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। কারণ, এমন প্রায় সবগুলো ঘটনার পরই ফ্রান্স মুসলিমবিরোধী আইন করে।
চলতি মাসের শুরুতে মাক্রোঁ বলেছিলেন, ‘চরমপন্থার কারণে বিশ্ব জুড়ে ইসলাম সংকটে পড়েছে।’ তাঁর এই মন্তব্যে বিশ্বজুড়ে তুমুল প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ হয়। তাঁর এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তৈয়ব এরদোয়ানও।
মাক্রোঁর এই বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ধর্ম নিয়ে ১৯০৫ সালের একটি আইনকে শক্তিশালী করতে ডিসেম্বরে বিল আনা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ফ্রান্সে মৌলবাদ দূর করা হবে বলেও তিনি অঙ্গীকার করেন।
তো, একটি বিল যখন সামনে তখন, মুসলিমদের ‘চরমপন্থী’ প্রমাণ করা মাক্রোঁদের জন্য খুব জরুরি।
মাক্রোঁরা মুসলিমবিরোধী আইন করুক। এক সময় মুসলিমরাই হয়তো ফ্রান্সের আইন প্রণেতা হবে। সেই ভোর কি খুব দূরে?
লেখক: বিশিষ্ট সাংবাদিক, ও কলামিস্ট