নিজস্ব প্রতিবেদক:: সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিরীহ লোকজনকে হয়রানির অভিযোগ অনেক পুরনো। নিরীহ লোকদের ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে পিটিয়ে কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। তাদের এই অপকর্ম থেকে মাদ্রাসার ছাত্ররাও বাদ পড়েননি। বিশেষ করে আকবর ভূইয়া দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এ ফাঁড়িতে একের পর এক অপকর্ম চলছে।
তাৎক্ষণিক ভয়ে কেউ মুখ না খুললেও রায়হান আহমদ হত্যাকান্ডের পর অনেকেই বিষয়টি প্রকাশ করছেন। সিলেট পুলিশ সুপার কার্যালয়ের লাগোয়া এবং এসএমপি’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁিড়তে এসব অপকর্ম ঘটলেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে একবারও মাথা ঘামায়নি, ফলে রায়হানের মতো একটি তরতাজা প্রাণ মাত্র ১০হাজার টাকার জন্য বিলিয়ে দিতে হল। সব মিলিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি যেন একটি অঘোষিত টর্চারসেল।
ঘটনা-১
সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জামেয়া ক্বাসিমুল উলুম দরগাহে হযরত শাহজালাল (রহ:) মাদ্রাসার দস্তারবন্দী সম্মেলনে অংশ নিতে আসা কয়েকজন মাদ্রাসা ছাত্র চৌহাট্টার একটি রেস্তোরাঁয় চা পান করছিলেন। হঠাৎ করে দুই পুলিশ সদস্য মাদ্রাসার এক ছাত্রকে ধরে নিয়ে একটি সিএনজি অটোরিকসায় তুলে। অটোরিকসায় আগে থেকেই এক নারী বসা ছিলেন। পরে নারীসহ তাকে নেয়া হয় বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে। নারীর পাশে দাঁড় করিয়ে ঐ ছাত্রের ছবি তুলে পুলিশ। এসব দেখে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা ‘মিশকাত ক্লাসের’ ছাত্রটি হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেয়। পুলিশ বলে, ‘যদি তুমি টাকা আনাতে পার তাহলে ছেড়ে দেব, না হয় পত্রিকায় এই ছবি পাঠিয়ে দেয়া হবে। অসহায় ছাত্রটি বাড়িতে মায়ের কাছে কল দিয়ে ১০ হাজার টাকা দিতে বললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁড়ির এসআইর মোবাইলে বিকাশ করে দেয়া হয় ৮ হাজার টাকা। পরে ছাত্রকে ছেড়ে দেয়। ঘটনার শিকার ছাত্রটি একটি সংবাদপত্র অফিসে এসে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলে কোতোয়ালী থানার তৎকালীন ওসি আসাদুজ্জামানকে বিষয়টি জানানো হয়। ওসি জেনে ওই এসআইকে কঠোর ভাষায় শাসানোর পর এসআই ছুটে যান ঐ সংবাদপত্র অফিসে। পুলিশের পোশাক পরিহিত অবস্থায়ই এসে পুরো ৮ হাজার টাকা ফেরত দেন এবং ঘটনার শিকার ছাত্রের নিকট সাংবাদিকদের সামনেই ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ভুক্তভোগী ঐ ছাত্র সে সময় ভয়ে আর মুখ খুলেননি।
ঘটনা-২
জগন্নাথপুরের যুবক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে নগরে আসেন। তিনি সন্ধ্যার পরে আসেন নগরের প্রাণকেন্দ্র কোর্ট পয়েন্টে। কোর্ট পয়েন্টের কালেক্টরেট মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে চানাচুর খাওয়ার সময় হঠাৎ দুই যুবক এসে বেড়াতে আসা ওই যুবককে ঝাঁপটে ধরে। দুই যুবক তার মানিব্যাগ, মোবাইল সেটটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তাকে কয়েকটি চপেটাঘাতও করে। ঘটনার শিকার যুবকটি বিষয়টি তাৎক্ষণিক তার পরিচিত ব্যক্তিকে জানান। সন্দেহজনকভাবে ঘটনার শিকার যুবককে নিয়ে ঐ ব্যক্তি বন্দরবাজার ফাঁড়িতে যান। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মানিব্যাগ ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়া দুই যুবককে শনাক্ত করেন ঘটনার শিকার যুবক। পরে জানা যায়, ঐ দু’যুবক হলেন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত কনস্টেবল। বিষয়টি তাৎক্ষণিক ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ (বর্তমানে পরিদর্শক) এস আই রঞ্জন সামন্তকে জানানো হলে তিনি লিখিতভাবে অভিযোগ দিতে বলেন। ঘটনাটি সে সময়কার উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর) রেজাউল করিমকেও জানানো হয়। তিনিও লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। অভিযোগ দিলে এ্যাকশন নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। কিন্তু ঘটনার শিকার যুবক লিখিত অভিযোগ না দিয়েই পুলিশ ফাঁড়ি থেকে চলে যান। যুবক বলেন, মূলত ভয়েই তিনি অভিযোগ দেননি। ঘটনাটি তিনি এখনো ভুলতে পারেননি।
ঘটনা-৩
হযরত শাহজালাল (রহ:) মাজার জিয়ারত করতে এসেছেন নরসিংদীর এক দম্পতি। নগরের চৌহাট্টায় ভোরে পুলিশের মুখোমুখি হন তারা। নানান জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তাদেরকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদের কাছ থেকে নগদ অর্থ রেখে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে তারা শাহজালাল (রহ:) মাজার জিয়ারত করেছিলেন ঠিকই; তবে মাজার জিয়ারতের পরই সিলেট ছেড়ে চলে যান। ঘটনাটি পরে কোতোয়ালী থানার তৎকালীন ওসি সোহেল আহমদকে জানানো হয়েছিল বলে তারা জানান।
বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তাদের হাতে রায়হান আহমদ নামের এক যুবক খুনের সংবাদের পরই সর্বত্র বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির নাম আলোচনায় আসে। ভুক্তভোগীরা এভাবে তাদের বর্ণনা দেন। কিন্তু হয়রানির ভয়ে এখনো তারা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতেও রাজি হননি।
ভুক্তভোগীরা জানান, নগরীর পুলিশ ফাঁড়ি সমূহে মূলত এসআই, এএসআই ও কনস্টেবলরা দায়িত্ব পালন করেন। এসআইদের মধ্যে বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্তরাও রয়েছেন। ফাঁড়ির কর্মকর্তারাই লোকজনের সাথে বেশি যোগাযোগ রাখেন-টহল দেন। মাঠ পর্যায়ের এ সকল কর্মকর্তার মধ্যে কেউ কেউ এমন অপকর্ম করেন, যার ফলে পুলিশ বাহিনীর দুর্নাম হয়। অথচ সিনিয়র কর্মকর্তারা এ সকল ঘটনা জানেনই না। মাঠ পর্যায়ে সিনিয়র কর্মকর্তাদের কঠোর নজরদারী প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) জ্যোতির্ময় সরকার জানান, রায়হান হত্যাকান্ডের ঘটনায় বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জসহ ৪ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রায়হান নিহতের বিষয়টি তদন্ত করছেন।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক ‘সুজন’ সিলেট জেলার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রায়হান আহমদ হত্যাকান্ডের পর বন্দরবাজার ফাঁড়ির কর্মকর্তাদের অপকর্মের বিষয়টি সামনে আসে। ফাঁড়ির প্রতি নজরদারী না থাকায় এমন ঘটনা ঘটছে। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। অপরাধে সম্পৃক্ত পুলিশ সদস্যেরও আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। এটি করা না গেলে কোনোভাবেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।