কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে। ক্যাম্পে আশ্রিত স্বশস্ত্র রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে চলছে। এক সময় রাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসব সন্ত্রাসীরা অস্ত্রবাজি করলেও এখন দিনরাত তাদের কাছে সমানে পরিণত হয়েছে। দিন-দুপুরে ক্যাম্পগুলোতে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব চালাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোরতা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক একাধিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর হাতেহাতে পৌঁছে গেছে অস্ত্র। অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে তারা ক্যাম্পের ভেতরে বাইরে ডাকাতি, অপহরণ, খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংগঠিত করছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহ করতে এদেশের অস্ত্র কারবারিদের সম্পৃক্ততায় পাহাড়ের গহীন অরণ্যে স্থাপন করা হয়েছে অস্ত্র তৈরির কারখানা। গত শনিবার ভোর রাতের অভিযানে এমন একটি অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১৫) সদস্যরা। অভিযানে দুইটি দেশে তৈরি অস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ অস্ত্র তৈরির দুইজন কারিগরকে আটক করতে সক্ষম হয়।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া অভিযানের পরেও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা যেন থেমে নেই। র্যাবের অস্ত্র উদ্ধারের পরের দিন রবিবার বিকালে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রধারী দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এ ঘটনায় তিনজন রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং দশজন রোহিঙ্গা আহত হয়। আহতরা ক্যাম্পে অবস্থিত হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং চাকমারকুল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান পরিচালনা করে চারটি দেশে তৈরী অস্ত্র, ২০ রাউন্ড কার্তুজসহ নয়জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করেছে র্যাব-১৫ এর একটি আভিযানিক দল। আটকরা উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা এবং কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোলাগুলির ঘটনায় জড়িত বলে জানিয়েছে র্যাব।
কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর উপ অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান বলেন, কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা করেছিল। দুই দিন আগে র্যাব তাদের ধরতে অভিযান চালায়। এক পর্যায়ে তারা কুতুপালং ছেড়ে হোয়াইক্যং চাকমারকুল নামক রোহিঙ্গা সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নেয়। গোপন সংবাদে তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে অভিযান চালায় র্যাব। এসময় চারটি অস্ত্রসহ নয়জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়।
মেজর মেহেদী আরো জানান, এর আগে গত শনিবার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন মধুরছড়া নামের একটি পাহাড়ে অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পায় র্যাব। এসময় সেখান থেকে দুইটি দেশে তৈরি অস্ত্র, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ দুজনকে আটক করা হয়। আটকরা জেলার মহেশখালী থেকে এসে উখিয়ার গহীন পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করে অস্ত্র তৈরি করতেন। এর পর তা সরবরাহ করতেন রোহিঙ্গাদের কাছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ চালিয়ে আসছিলেন।
সরেজমিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে জানা যায়, গত তিন বছরে উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের নেতৃত্বে ক্যাম্পে গড়ে ওঠেছে একাধিক স্বশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা অস্ত্রের মুখে ক্যাম্পে অপহরণ, খুন, ডাকাতি, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণসহ ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটায়। শুধু ক্যাম্পের অভ্যন্তরে নয়, ক্যাম্পের বাইরেও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গেও বিভিন্ন সময় সংঘর্ষে লেগে যায়। স্থানীয় অনেকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, মানবতার খাতিরে এদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ক্যাম্পে উঠতি বয়সের রোহিঙ্গারা বিভিন্ন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী সংগঠনে যুক্ত হচ্ছে। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে অস্ত্র। ক্যাম্পের বসবাসকারী সাধারণ রোহিঙ্গা, স্থানীয় বাসিন্দা, ক্যাম্পে কর্মরত দেশি-বিদেশি বেসরকারী সংস্থার কর্মীসহ কেউ নিরাপদ নয় এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে।
এক সময় রাতের আঁধারে সন্ত্রাসের নেতৃত্ব দেওয়া রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা এখন দিন দুপুরে প্রকাশ্যে ক্যাম্পে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কথায় কথায় তারা স্থানীয় গ্রামবাসীদের পর্যন্ত তুলে নিয়ে যাওয়া এবং হত্যার হুমকি দেয়। গত কিছুদিন আগে উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় অবস্থিত স্থানীয় সিএনজি অটোরিকশা চালকদের সংগঠনের কার্যালয়ে অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।
এর আগে গতবছর টেকনাফের হ্নীলায় স্থানীয় যুবলীগ নেতা উমর ফারুককে গুলি করে হত্যা করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। গত তিন বছরে উখিয়া ও টেকনাফে স্বশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দ্বারা ডাকাতি, অপহরণ ও খুনের অহরহ ঘটনা ঘটিছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে স্থানীয়রাসহ খোদ ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারাও উৎকণ্ঠায় রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গা আগমণের তিন বছরে গত আগস্ট মাস পর্যন্ত ১২ ধরনের অপরাধে রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ৭৩১টি মামলা হয়েছে। যাতে আসামি হয়ে এক হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে ৫৩টি খুন, ৫৯টি অস্ত্র, ৪১০টি মাদক, ৩৫টি ধর্ষণ, ২৮টি মানবপাচার, ১০টি ডাকাতি এবং ১৬টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা উল্লেখযোগ্য।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা ও বৌদ্ধদের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে প্রাণ রক্ষায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়ের তিন বছর অতিক্রম হয়েছে। সংকটের এই তিন বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকগুলো অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়েছে। প্রত্যাবাসন না হলে ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অপরাধ দমনে সরকারের আরো কঠোর হওয়া দরকার বলে মনে করেন স্থানীয় সচেতন মহল।