বহুল আলোচিত সিলেট নগরীর তারাপুর চা বাগানের মালিকানার বিষয়ে কথিত সেবায়েত পংকজ কুমার গুপ্তের দাবী খারিজ করে দিয়েছেন উচ্চ আদালত। সেই সাথে দেবোত্তর সম্পত্তি ঘোষিত এই বাগান পরিচালনার লক্ষ্যে ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই কমিটিই বাগানের ভূমিসহ যাবতীয় ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
তারাপুর চা বাগানের স্বত্ব নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে দাখিল করা ৩টি রিভিউ পিটিশনের শুনানী শেষে আদালত এই নির্দেশনা প্রদান করেন।
তারাপুর চা বাগানের মালিকানা সংক্রান্তে রাষ্ট্রপক্ষের দায়ের করা সিভিল আপীল মোকদ্দমা নং- ১৬৩/২০০৯ এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় বিগত ১৯ জানুয়ারী ২০১৬ ইং তারিখে। বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে গঠিত ৪ সদস্যের বেঞ্চ এ আপীলের রায় প্রদান করেন। ঐ রায়ের বিরুদ্ধে ৩টি রিভিউ আবেদন দাখিল করা হয়। এর একটি আবেদন দাখিল করেন বাগানের লেসি আব্দুল হাই। অপর দুটি আবেদন দাখিল করা হয় জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ ও তারাপুর এলাকার ভূমি গ্রহীতাদের পক্ষে। ৩টি রিভিউ আবেদন এক সাথে শুনানী হয়। ৫ দফা শুনানী শেষে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসাইনের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের আপীল বেঞ্চ আবেদন পর্যালোচনা শেষে পর্যবেক্ষণসহ বিষদ রায় প্রদান করেন। ৭ সদস্যের আপীল বেঞ্চের অন্য সদস্যরা ছিলেন-মাননীয় বিচারপতি মোহাম্মদ ঈমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি র্মিজা হোসাইন হায়দার, বিচারপতি জিনাত আরা, বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামান।
রায়ে আদালত উল্লেখ করেছেন, তারাপুর চা বাগানকে দেবোত্তর সম্পত্তি ঘোষণা করে এর সংরক্ষণ ও তত্বাবধানের জন্য একটি ব্যাবস্থাপনা কমিটি গঠণের নির্দেশ দিয়েছেন। ১১ সদস্যের এই ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা হবেন- জেলা প্রশাসক মনোনীত সিলেট নগরীর হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের একজন হিন্দু কাউন্সিলর, সিলেট জেলা পরিষদের একজন হিন্দু সদস্য বা জেলা পরিষদ মনোনীত একজন হিন্দু বিশিষ্ট ব্যক্তি, শ্রী চৈতন্য কালচারাল সোসাইটির অধ্যক্ষ, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতি মনোনীত একজন হিন্দু প্রতিনিধি, সিলেটের জেলা জজ মনোনীত একজন হিন্দু বিচারক, শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ জিউ দেবতার সেবায়েত, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন হিন্দু শিক্ষক, প্রয়াত বৈকুন্ঠ চন্দ্র গুপ্তের একজন উত্তরাধিকারী, সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মনোনীত একজন হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তা ও যুগলটিলা আখড়া কমিটির একজন প্রতিনিধি। ৫ বছরের জন্য এই ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হবে। এই ১১ জন মনোনীত ব্যক্তির মধ্য থেকে কমিটির সভাপতি, সহ সভাপতি, সচিব/সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ ও সহ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন। সভাপতি এই কমিটির নির্বাহী প্রধান হিসেবে থাকবেন। সভাপতির নির্দেশে সচিব/সেক্রেটারী সার্বিক দায়িত্ব পালন করবেন। এই ব্যবস্থাপনা কমিটিই শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ জিউ দেবনার পূজারীসহ অন্যান্য সেবায়েত নিয়োগ করবেন। ব্যবস্থাপনা কমিটিম সচিব/সম্পাদক তারাপুরের দেবোত্তর সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব ও দলিলাদি সংরক্ষণ করবেন এবং অপদখলীয় সম্পত্তির তালিকা প্রস্তুত করবেন এবং দেবোত্তর সম্পত্তির একটি পূণাঙ্গ তালিকা সিলেটের জেলা জজ এর কাছে জমা দেবেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমোদন ছাড়া তারাপুরের দেবোত্তর সম্পত্তির বিক্রয়, লিজ বা হন্তান্তর করা যাবেনা।
দীর্ঘ ৩৫ পৃষ্ঠার এই রায়ে বিজ্ঞ আপীল বেঞ্চ কথিত সেবায়েত পংকজ কুমার গুপ্তের দাবী প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন। রায়ে আদালত বলেছেন, শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ জিউ দেবতার বিগ্রহ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যুগলটিলা আখড়া কমিটির কাছে হস্তান্তর করে সপরিবারে ১৯৮৮ সালে দেশ ত্যাগ করেন পংকজ। এর পর থেকে এই বিগ্রহের দায়িত্বে রয়েছে চৈতন্য কালচারাল সোসাইটি। পরবর্তীতে পংকজ কুমার গুপ্ত সরকারী অনুমতি সাপেক্ষে ১৯৯০ সালে তারাপুর চা বাগানের দখল লীজমূলে জনাব আব্দুল হাইর কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর কখনোই পংকজ কুমার গুপ্ত উক্ত লীজ দলিলটি জাল বা ভুয়া বলে কোথাও কোন অভিযোগ করেননি বা হস্তান্তরিত সম্পত্তি পুনরুদ্ধারেরও কোন উদ্যোগ নেননি। আদালত বলেন, কোন সেবায়েত কোন সম্পত্তি সরকারের অনুমতি নিয়েও কারো কাছে হস্তান্তরের অধিকার রাখেন না। অথচ, পংকজ কুমার গুপ্ত তাই করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আদালত সিলেটের জেলা প্রশাসক কর্তৃক এটর্নী জেনারেল বরাবরে প্রেরিত একটি পত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘পংকজ কুমার গুপ্তের পরিবর্তে শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউ দেবোত্তর সম্পত্তির সেবাইত হিসেবে চৈতন্য কালচারাল সোসাইটি/ইসকনকে সেবাইত গণ্য করার জন্য নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ ব্রহ্মচারী, অধ্যক্ষ সি.সি.এস/ইসকন, যুগলটিলা, সিলেট একটি আবেদন দাখিল করেন। উক্ত আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউ বিগ্রহকে তৎকালীন সেবাইত পংকজ কুমার গুপ্ত শ্রী শ্রী রাধামাধব মন্দির, যুগলটিলা কাজলশাহ সিলেটকে বুঝিয়ে দেন। তৎকালীন আখড়া পরিচালনা কমিটি কর্তৃক ১৯৯৪ ইং সনে রেজিষ্ট্রারী দলিলের মাধ্যমে আখড়ার ব্যবস্থাপনা চৈতন্য কালচারাল সোসাইটি/ইসকনকে প্রদান করা হয়। তৎপরবর্তীতে জনাব পংকজ কুমার গুপ্ত ১৯৮৮ সন হতে অধ্যাবধি সেবাইত হিসেবে দেবতার সম্পত্তি শাসন, সংরক্ষণ না করে দেবতার সেবা ও পূজার ভার যুগলটিলা আখড়া কমিটির কাছে ন্যস্ত করে অন্য দেশে চলে যান। তিনি (পংকজ কুমার গুপ্ত) বর্তমানে ভারতীয় নাগরিক, সেহেতু তিনি বাংলাদেশের কোন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। তিনি দেবতার সমুদয় সম্পত্তি রাগীব আলীর পুত্র আব্দুল হাই এর কাছে হস্তান্তরের জন্য ৯৯ বছরের জন্য অবৈধ চুক্তি করেছেন। মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের রায়ের ফলে তিনি সেবাইত হওয়ার অবৈধ দাবী করেছেন। তারাপুরস্থ রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের সেবা-পূজা সমূহ সম্পদ ব্যাবস্থাপনা এবং পরিচালনার জন্য চৈতন্য কালচারাল সোসাইটি/ইসকনকে সেবাইত হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করেন”।
আদালত বলেন, পংকজ কুমার গুপ্ত বিগ্রহের সংরক্ষণ বা ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয়েছেন। দেবোত্তর সম্পত্তি তিনি বেআইনীভাবে হস্তান্তর করেছেন। তার দায়িত্বহীন আচরণের কারণে ডা. পংকজ কুমার গুপ্ত এই পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন।
মাননীয় বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রদত্ত মূল আপীল মামলার রায়ের রিভিউ আবেদনকারী, তারাপুর চা বাগানের লিজ গ্রহীতা আব্দুল হাইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ৫ কোটি টাকা সেবায়েতকে ফেরত দেয়ার জন্য। রিভিউ আবেদনে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসাইন এই টাকার অংক কমিয়ে ৩ কোটি টাকা আগামী ৬ মাসের মধ্যে ব্যবস্থাপনা কমিটির নিকট হস্তান্তরের জন্য জনাব আব্দুল হাইকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। তবে, অপর দুই রীটকারী জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ ও ভূমি গ্রহীতাদের এই আপীলে কোন আইনগত অবস্থান না থাকায় তাদের আবেদনের ব্যাপারে কোন নির্দেশনা দেননি আদালত।
রিভিউ আবেদনকারী আব্দুল হাই ও জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজের পক্ষে রিভিউ আবেদন শুনানী করেন ব্যরিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও ভূমি গ্রহীতাদের পক্ষে শুনানীতে অংশ নেন ব্যরিস্টার ফিদা এম. কামাল।
রিভিউ রায়ের ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে সিলেট জেলা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ সিলেটের ডাক-কে বলেন, বহুল আলোচিত এই মামলার রিভিউ পিটিশনের ৩টির যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করা হয়েছে, তা অত্যন্ত সুলিখিত ও সুচিন্তিত। তারাপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপনায় যে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা যথাযথ। এর ফলে, দেবতার সম্পত্তি সুরক্ষায় সমগ্র সিলেটের হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি দ্রুত এই ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। #