ভাগ্য সহায় হচ্ছে না শফিকুর রহমান চৌধুরীর। সিলেট আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার ভাগ্য ‘সুতোয়’ ঝুলছে। ঘটতে পারে অনেক কিছুই- এমন আশঙ্কাও আছে। অথচ কিছু দিন আগেও এই শফিকুর রহমান চৌধুরী এক হাতেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন সিলেট আওয়ামী লীগকে। এমপিও ছিলেন সিলেট-২ আসনে। তার কাছেই পরাস্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ, বিএনপির জাঁদরেল রাজনীতিকরা। এ কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সিলেট আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক মহলের একজন। কিন্তু এখন সিলেট আওয়ামী লীগের বর্তমান দায়িত্বশীলরাই শফিকুর রহমান চৌধুরীকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় মেতে উঠেছেন।
২৪ ঘণ্টার রাজনীতিবিদ বলা হয় শফিকুর রহমান চৌধুরী। ৭৫’র পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে সিলেটে নিজেকে প্রকাশ করেন। এরপর পারিবারিক কারণে চলে যান লন্ডনে। সেখানে তিনি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। লন্ডনের বাঙালিদের মধ্যে পুরাতন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত তার পরিবার। দীর্ঘ সময় লন্ডনেই রাজনীতি করেন। ২০০৬ সালের পর সিলেট-২ আসনে বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীকে ঠেক্কা দিতে নেতা খুঁজছিলো আওয়ামী লীগ। তখনই খোঁজ মিলে তার। গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই নিজ এলাকা বিশ্বনাথ ও বালাগঞ্জের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নামেন শফিকুর রহমান চৌধুরী। ওয়ান-ইলেভেনর সময় হন গ্রেপ্তারও। পরবর্তীতে তিনি সিলেট-২ আসনে আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়ে যান। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শফিকুর রহমান চৌধুরী বিএনপির জাঁদরেল রাজনীতিক এম ইলিয়াস আলীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। সবার নজরে কাড়েন তিনি। ইলিয়াসকে পরাস্ত করার কারনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও তার কদর বেড়ে যায়। তখন সিলেট আওয়ামী লীগের কর্ণধার ছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আনম শফিকুল হক ও মুক্তিযোদ্ধা ইফতেখার হোসেন শামীম। নিজ এলাকা সহ সিলেটের রাজনীতিতেও দাপট দেখাতেন তারা দু’জন। তাদেরকে সমীহ করতো সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সিলেট-২ আসনে চমক দেখানো শফিকুর রহমান চৌধুরী বনে যান ‘তুরুপের তাস’। তখনকার এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরীকে দায়িত্ব দেয়া হয় সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। তখন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইফতেখার হোসেন শামীম। একই সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অনেকটা ছিটকে পড়েন আরেক রাজনীতিবিদ আনম শফিকুল হকও। আব্দুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ান ও শফিকুর রহমান চৌধুরীর দায়িত্বপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সিলেট আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ইতি ঘটে শফিক-শামীম যুগের। ওই সময় হয়েছে নানা ক্ষোভ-বিক্ষোভ। এখন অবশ্য আর জীবিত নেই আনম শফিকুল হক ও ইফতেখার হোসেন শামীম। এরপর শফিকুর রহমান চৌধুরী তার রাজনৈতিক দক্ষতায় সিলেট আওয়ামী লীগে নিজের জায়গা করে নেন। ২০১১ সাল থেকে শফিকুর রহমান চৌধুরী সিলেট আওয়ামী লীগকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। এখনকার উপজেলা পর্যায়ের সাজানো আওয়ামী লীগ শফিকুর রহমান চৌধুরীর হাত ধরে পুনর্গঠিত হয়েছে। তবে- নিজ নির্বাচনে আসনে তিনি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন বারবার। বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলায় আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় একটি পক্ষ। পরবর্তীতে ওই পক্ষের নেতা হিসেবে পরিচিত পান যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। শফিক-আনোয়ার সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিলো না। সম্পর্কের ফাটল সেই যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে। এ কারণে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীও ধীরে ধীরে সিলেট-২ আসনে তার অবস্থান শক্তিশালী করে তোলেন। বিদ্রোহী নেতারা আনোয়ারুজ্জামানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিকল্প হিসেবে শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেন। শফিকুর রহমান চৌধুরী সিলেটের রাজনৈতিক জীবনে প্রথম অগ্নিপরীক্ষায় পড়েন ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তখন সিলেট-২ আসনের এমপি তিনি। ওই সময় নির্বাচনের রাজনৈতিক কারণে সিলেট-২ আসনটি জাতীয়পার্টিকে ছাড় দিতে হয়েছিলো। নির্বাচনী মাঠে অবস্থান ভালো থাকার পরও শফিকুর রহমান চৌধুরী দলের স্বার্থে তার এমপি পদটি বিসর্জন দেন। নিজে নির্বাচনী ময়দান থেকে সরে গিয়ে জাতীয়পার্টির প্রার্থী ইয়াহহিয়া চৌধুরীকে জয়লাভ করতে মাঠে কাজ করেন। সফলতাও পান শফিক চৌধুরী। এরপর থেকে তিনি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক হিসেবে থাকেন। তবে- নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হননি শফিকুর রহমান চৌধুরী। প্রতিদিনই সকাল থেকে ছুটে যেতেন এলাকায়। আর ফিরতেন রাতে। এমপি না হলেও তিনি সব সময় নেতাকর্মী সহ মানুষের পাশাপাশি ছিলেন। ২০১৮ সালও তার জন্য একইভাবে ছিলো অগ্নিপরীক্ষার। ওই বছরও শফিকুর রহমান চৌধুরী প্রার্থীর জন্য প্রস্তুতি নিয়েও শরিক দলকে ছাড় দিয়েছিলো আসনটি। পরপর দুদফা তিনি দলের স্বার্থের জন্য তার সংসদীয় আসনটি মহাজোটের শরীক জাতীয়পার্টিকে ছাড় দেন। এরপরও সিলেট আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারলেন না শফিকুর রহমান। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভঙ্গুর অবস্থার কারণে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আটকে গেলেন তিনি। তার প্রতিপক্ষ হিসেবে বিভিন্ন উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিকল্প গড়ে তোলা হয়েছিলো। আর সম্মেলনের আগে প্রতিনিধি সম্মেলনে বিষয়টি প্রকাশ পায়। এতে করে তার উপর নাখোশ হন কেন্দ্রীয় নেতারা। এরই মধ্যে সিটি নির্বাচনেও পরাজয় ঘটে আওয়ামী লীগের। তিনি ছিলেন সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামরানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক। সব মিলিয়ে আটকা পড়েন শফিকুর রহমান চৌধুরী। গত বছরের ৫ই ডিসেম্বর তাকে সিলেট আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান। সাধারণ সম্পাদক থেকে শফিকুর রহমান চৌধুরীকে সরালেও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশ ছিলো তাকে যেনো জেলার সিনিয়র সহ সভাপতি পদটি দেওয়া হয়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে আবার সিনিয়র সহ সভাপতি পদ নিয়ে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন শফিক চৌধুরী। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন সিলেট-৩ আসনে এমপি মাহমদ উস সামাদ চৌধুরী। সিলেট আওয়ামী লীগের বর্তমান দায়িত্বশীলরাও তার পক্ষে। এ কারণে জেলার প্রস্তাবিত কমিটিতে সিনিয়র সহ সভাপতি পদে শফিকুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে মাহমদ উস সামাদ চৌধুরী এমপির নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। কেন্দ্র এখন সিদ্বান্ত নেবে- কে হবেন সিলেট আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। করোনাকালে প্রায় ৬ মাস লন্ডনে ছিলেন শফিক চৌধুরী। গত ১৫ই সেপ্টেম্বর ফিরে এসেছেন সিলেটে। দেশে এসে লড়াই চালাচ্ছেন টিকে থাকার। সিনিয়র সহ সভাপতি পদটি যেনো পান- সেই লবিংয়ে ব্যস্ত তিনি।
শফিকুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন- ‘আওয়ামী লীগের পদ পেলাম কী না সেটি বড় কথা নয়। আমি আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। সুতরাং আওয়ামী লীগেই থাকবো।’