এসবিএন নিউজ, নিজস্ব প্রতিবেদক: সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার লন্ডন প্রবাসীদের জমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অত্র উপজেলার স্থানীয় প্রভাবশালী আবদুল হাসিব মুনীয়া এবং আজির উদ্দিন এর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেন খাসা গ্রামের দিঘির পাড় এলাকার লন্ডন প্রবাসী মরহুম হাজি আবদুল হক এর ছেলে ইফতেখার আহমদ শিপন।
অভিযোগকারী শিপন বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে তারা লন্ডনে বসবাস করছেন। আর এ সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ইন্ধনে একই এলাকার কিছু লোক তাদের ৪০ বছর ধরে ভোগদখলে থাকা জমি জোর জবরদস্তি করে এবং মিথ্যা মামলা দিয়ে মালিকানা দাবি করছে। আর এ কাজে টাকা খেয়ে পুলিশ তাদের পক্ষে কাজ করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি আরো অভিযোগ করেন, সিলেটের নিজবাড়ীর সাথে কিছু নিচু জমিতে মাটিভরাট করতে গেলে মৃত ইরমান আলীর ছেলে আজির উদ্দিন জমির মালিকানা দাবি করে কোর্টে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ সঠিক তদন্ত না করে বাদী পক্ষের টাকা খেয়ে অসত্য রিপোর্ট কোর্টে প্রদান করে।
অভিযোগকারি ইফতেখার আহমেদ শিপন দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লন্ডনে বসবাস করলেও বাংলাদেশের পারিবারিক সম্পত্তি কেয়ারটেকারের মাধ্যমে দেখাশুনা করেন। সিলেটে বিয়ানীবাজারে খাসা গ্রামে দিঘির পাড় এলাকায় শিপনের পৈত্রিক বাড়ী হলেও কসবা গ্রামের বড় বাড়ীটি তার দাদার বাড়ী। পরিবার নিয়ে লন্ডনে থাকায় মাঝে মাঝে বাংলাদেশে এসে পারিবারিক সম্পত্তি দেখাশুনা করেন শিপন। লন্ডনে বেড়ে উঠায় বাংলাদেশের গ্রাম্য রাজনীতি কিংবা জবর দখলদারিত্ব সংস্কতির সাথে মোটেই পরিচিত নন তিনি।
গত বছরে জুলাই মাসে নিজ বাড়ী সংলগ্ন বিয়ানী বাজার থানাধীন খাসা মৌজার ১০৫ নং জেএল স্থিত, ৪০৭ নং দাগের ৪০ বছর ধরে ভোগদখলে থাকা ৭ শতাংশ জমি মাটি ভরাট করতে শুরু করেন শিপন। মাটি ভরাটের কাজ প্রায় সমাপ্ত হলেও কেউ কোন আপত্তি বা বাধা প্রদান করেননি। তার পরের মাসে অভিযোগকারীর বাবা মারা যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন স্থানীয় আজির উদ্দিন পুলিশ নিয়ে এসে কাজে বাধা সৃষ্টি করেন এবং কাজ বন্ধ করে দেন। গত নভেম্বর মাসে আজির উদ্দিন, জমির আসল মালিক ইফতেখার আহমদ শিপন এর পারিবারিক সম্পত্তি দেখাশুনাকারি আবদুল জলিল এবং শিপনের এক নিকটাত্মীয় ছাবু মিয়াকে আসামী করে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং- ৩৬/১৫ । পরে কোর্ট মামলা তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বিয়ানীবাজার থানাকে নির্দেশ প্রদান করে।
সুত্রে জানা গেছে, বিয়ানী বাজার থানার এসআই হাবিবুর রহমান, বিপি নং ৭৭৯৭০৪২৯৯৯ এর উপর ঘটনাটি তদন্তভার দেয়া হয়। এসআই হাবিবুর রহমান কোন সরেজমিনে তদন্ত ছাড়াই প্রভাবশালীদের চাপে ডিসেম্বরের ১২ তারিখে একটি একচেটিয়া, মিথ্যা ও পক্ষপাতিত্বমুলক রিপোর্ট কোর্টে জমা দেন। তদন্তকালে এসআই হাবিবুর রহমানে বিভিন্ন জালিয়াতি ও পক্ষপাতিত্বের সত্যতা মিলেছে। এর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো, তদন্ত রিপোর্টে এসআই হাবিবুর রহমান উল্লেখ করেছেন, সরেজমিনে তদন্তকালে সে ১নং সাক্ষী আবদুল হাসিব মুনিয়া, ২নং সাক্ষী আবদুল জলিল, ৩নং সাক্ষী কবির আহমদ, ৪নং সাক্ষী আবদুল মালিক, ৫নং সাক্ষী মখলিছ ও ৬নং সাক্ষী হবিবুর রহমানসহ উপস্থিত লোকজনকে প্রকাশ্যে ও গোপনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
তথ্যে বেড়িয়ে এসেছে ভিন্ন তথ্য, ১নং সাক্ষী আবদুল হাসিব মুনিয়াকে এ সাক্ষীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে কোনদিন পুলিশের কাছে এ বিষয়ে সে সাক্ষী দেয়নি বলে জানিয়েছে। পুলিশ তাকে না জানিয়ে তার নাম রিপোর্ট উল্লেখ করেছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছন তিনি এবং ফোন লাইনটি কেটে দিয়েছেন। ২নং সাক্ষী আবুদল জলিল, তাকে এ সাক্ষীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, পুলিশ কোন দিন এ বিষয়ে তার কাছে আসেনি এবং জিজ্ঞাসাও করেনি। তার নাম পুলিশ কিভাবে এ রিপোর্টে আনলো সেটি সে জানেন না। আর এ জলিলই বিরোধপূর্ন জমিতে ১৫ বছর ধরে চাষাবাদ করে আসছে এবং এ জমি শিপনদের পরিবারের বলেও দাবি করেন তিনি ।
৩নং সাক্ষী কবির আহমেদও একই কথা বলেছেন এবং এ বিষয়ে পুলিশ তার সাথে কখনো কোন কথা বলেনি। ৪নং আসামী আবদুল মালিক ইতিমধ্যে মারা গেছেন যে ছিল বাদীর ভাতিজা। ৫নং সাক্ষী মখলিছ মিয়া বাদীর ভাগিনা আর ৬নং সাক্ষী হল হবিবুর রহমান অন্য গ্রামের যাকে মিথ্যা ভাবে একই গ্রামের বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ থেকে স্পষ্টত বুঝা যায় এটি একটি মনগড়া এবং পক্ষপাতিত্বমুলক রিপোর্ট।
এসআই হাবিবুর রহমান তার রিপোর্টে মিথ্যাভাবে অদৃশ্য কোন কারণে জমির মুল মালিককে এখন জবর দখলদার হিসেবে উল্লেখ করেছেন যা পুরোটাই অবাস্তব ও কল্পনাপ্রসুত। এ সব মনগড়া রিপোর্টের বিষয়ে এসআই হাবিবুর রহমানের সাথে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। যদিও থানা থেকে বলা হয়েছে সে অন্যথানায় বদলি হয়ে গেছে।
কেঁচো খুড়তে সাপ:
জমির মালিকানা দ্বন্দ্বের কারণ খুঁজতে গিয়ে কেঁচো খুড়তে সাপ বেড়িয়ে এসেছে আমাদের অনুসন্ধানে। জমির মালিকানার ইতিহাসে দেখা যায় ১৯৩৮ সালে মার্চ মাসের পহেলা তারিখে তিনটি হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে ২৪ শতাংশ জমি ক্রয় করে নাফিজা বিবি নামে এক মহিলা। যার নম্বার হল পঞ্চ খন্ডের মগরা গোল ১১৫৬৭/১৫ যার তাল্লুক হল কৃষনো বাল্লব পাল। তারপর উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া এ জমি নাফিজা বিবির নাতিরা ১৯৬১, ১৯৬২ এবং ১৯৬৩ সালে কিছু কিছু অংশ করে খাসা গ্রামের ওয়াতির আলীর ছেলে খসির আলী, মহতাছিন আলি, মদরিছ আলির কাছে বিক্রি করে। ১৯৭৭ সালে ৪০৭ দাগের ভোগ দখলে থাকা ৭ শতাংশ জমি একই গ্রামের মৃত হাজি আবদুল হক এর কাছে বিক্রি করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে এ জমি ভোগ দখলে আছেন হাজি আবুদল হক এর পরিবার। আমাদের অনুসন্ধানে আরো দেখা যায়, ১৯৯৩ সালের ভোগ দখল অবস্থায় আবদুল হাসিব মুনিয়া ক্রয়সুত্রে তার ২২ শতাংশ জমি আজির উদ্দিন এবং তার ভাইদের কাছে বিক্রি করে দেন। আবার ১৯৯৫ সালে আজির উ্িদ্দন এবং তার ভাইরা ১৮ শতক জমি ক্রয় করে বলে কাগজ কলমে দাবি করেন যদিও সরেজমিনে এ জমির কোন অস্তিত্ব নেই। একই দাগে ক্রয়করার মত বাকী থাকে মাত্র ১১ শতাংশ সেখানে নিজেদের নামে ভূয়া কাগজ দিয়ে কাউকে না জানিয়ে ১৮ শতাংশ রেকর্ড করে নেয় আজিরউদ্দিনরা।
যেখানে মাঠে ৪০ শতাংশ জমির মধ্যে শিপনদের পরিবারের ভোগ দখলে আছে ৭ শতাংশ, হাসিব মুনিয়ার ২২ শতাংশ আর বাকী থাকে ১১ শতাংশ কিন্তু সে কি করে ১৮ শতাংশ জমি ক্রয় করে? মাঠে যেখানে জমির পরিমান ৪০ শতাংশ সেখানে সে কি করে ৪৭ শতাংশ বানাতে চেষ্টা করে? আজির উদ্দিন ১৯৯৫ সাল থেকে কখোনো শিপনদের সাথে জমির বিষয়ে এর আগে কখনো কোন কথা বলেনি বলে শিপনের পরিবার দাবি করেন। যদিও ২০১৩ সালে আজির উদ্দিনের ভাই নুরুল আলম তেরা মিয়া শিপনদের জমির পাশের তার অংশ ১০ শতাংশ জমি আশিক আহমেদ পতুলের স্ত্রী হোসনা আহমেদ এর কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। আমাদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আজির উদ্দিনরা মাঠে অল্প জমি থাকলেও কাগজ কলমে বেশি জমি ক্রয় দেখিয়েছেন। আর এ সুবাদে, লন্ডন প্রবাসী ইফতেখার আহমদ শিপনের ভোগদখলকৃত জমি পুলিশের সহযোগিতায় দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
সিলেট ভূমি অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী দেখা যায়, আজির উদ্দিন ১৯৯৫ সালে আরফান আলীর নামে রেকর্ড করা ১৮ শতাংশ জমি তার ওয়ারিশদের কাছ থেকে ক্রয় করেন। আর আরফান আলী ১৯৫৬ সালে তার নামে ৪০ শতাংশ জমি রেকর্ড করে নেয়। রিপোর্টে দেখা গেছে, ১৯৩৮ সালে আরফান আলীর মা নাফিজা বিবির মাত্র ২৪ শতাংশ জমি ক্রয়সুত্রে মালিক ছিলেন। তাহলে কি করে আরফান আলী ৪০ শতাংশ জমির রেকর্ড মালিকানা দাবি করে? ভুমি অফিসে তথ্য অনুসন্ধান করেও বাকী ১৬ শতাংশ এবং তার মায়ের ক্রয়কৃত ২৪ শতাংশ জমি তার নামে কিভাবে, কোথায় থেকে রেকর্ড হলো এর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তবে, দেখা যায় ১৯৬১, ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে সে একই রেকর্ডকৃত জমির মধ্যে আবার বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ জমি ক্রয় করে নিয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন হল সেটি কিভাবে? যদি সে এই জমির মালিকই হত আবার কেন সে কিনতে যাবে? আর এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে আজির উদ্দিন ও তার আশ্রয়দাতারা। এই অনিয়ম ও ভুয়া রেকর্ডটি ব্যবহার করে একই দাগের বাকী জমিগুলো বেদখলের চেষ্টা করছে তারা। এ কাজে স্থানীয় প্রভাবশালী আবুদল হাসিব মুনিয়া ও পুলিশের যোগসাজস রয়েছে বলেও সত্যতা পাওয়া যায়।
এ সব বিষয়ে আজির উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমি আরফান আলীর ওয়ারিশদের কাছ থেকে জমি কিনলেও তারা আমাকে এতো বছর জমি বুঝিয়ে দেয়নি এবং এটা সত্য যে এ জমি বহু বছর ধরে শিপনদের ভোগ দখলে আছে। তবে, আরফান আলীর বিরুদ্ধে মামলা না করে কেন শিপনদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে এর কোন উত্তর দিতে পারেনি তিনি।
অভিযোগকারি শিপন আরো জানান, এর আগেও এই আজিরউদ্দিন তার বাড়ীর সীমানা দেয়াল নির্মান করার সময় বাধাঁ প্রদান করে এবং এ বিষয়ে শিপন আদালতে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করেন।