সিলেটের টিলাগড় এলাকার শাপলাবাগ। ১৪ বছর আগে সিলেটে কয়েকটি দিনকে আতঙ্কিত আর বিভীষিকাময় করে তোলা সেই ‘বাংলা ভাইকে’ গতকাল মনে করিয়ে দিলো টিলাগড় শাপলাবাগেরই আরেকটি বাড়ি। ‘সূর্য্য দীঘল’ থেকে ‘শাহ ভিলা’- সেই জেএমবি, সেই ভয়ানক জঙ্গি আতঙ্ক।
আবু ইসহাকের বই ও চলচ্চিত্র দেখে ভালো লাগা থেকে সিলেট নগরীর টিলাগড়ের পূর্ব শাপলাবাগ আবাসিক এলাকায় এ ব্লকের ২ নং রোডের ২২ নম্বরে স্বপ্নের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ নির্মাণ করেন লন্ডন প্রবাসী আব্দুল হক। আর সেই স্বপ্নের সূর্যের দীঘল বাড়ি একসময় হয়ে ওঠে দু:স্বপ্নের ইতিহাস। অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাড়িটি তৈরি করা হলেও এটিকে ঘিরে কালো ইতিহাস রচিত হয় ২০০৬ সালে।
২০০৬ সালের ২ মার্চ র্যাবের দু:সাহসী অভিযানে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ থেকে ধরা পড়েন জঙ্গি সংগঠন জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শ্বাসরুদ্ধকর অপারেশনে বাড়ির গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও ছাদ ফুটো করে নানা কৌশলে সেদিন বাড়িটি থেকে মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও তার স্ত্রী-সন্তানসহ দুই সহযোগিকে রক্তপাতহীন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
পরে উত্তেজিত জনতা বাড়িটির দরজা, গ্রিল, জানালা, দেয়াল, জানালার কাঁচ সব ভেঙে ফেলে এবং বাড়িটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। একে একে ১৪টি বছর পেরনোর পর গতকাল সেই ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র কালোদিন আর ভয়ঙ্কর বাংলা ভাইকে মনে করিয়ে দেয় একই এলাকার ‘শাহ ভিলা’ নামের আরেকটি বাড়ি।
১৪ বছর আগে ‘সূর্য দীঘলে’ আস্তানা গেড়েছিলো জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এবারও এই এলাকার ‘শাহ ভিলায়’ আশ্রয় নেয় সেই জেএমবির অনুসৃত নব্য জেএমবি। গতকাল মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ‘শাহ ভিলা’ থেকে উদ্ধার করে জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহৃত কয়েকটি কম্পিউটার।
গত ২৪ জুলাই রাত পৌনে ১০টার দিকে ঢাকাস্থ পল্টনের পুলিশ চেকপোস্টের ২০০ গজ দূরে সড়কের পাশে একটি শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। তবে সে সময় ওই স্থানে কেউ না থাকায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি)-এর ভাষ্যমতে- সেই বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত জঙ্গিরা সিলেটে এসে আস্তানা গাড়ার খবর পায় পুলিশ। সে খবর অনুযায়ী গত রোববার দিবাগত রাতে (১০ আগস্ট) সিলেট নগরী এবং আশেপাশের কয়েকটি এলাকায় জঙ্গি ধরতে অভিযান চালানো হয়। অভিযানকালে সিলেট নগরীর মিরাবাজার উদ্দীপন-৫১ নম্বর বাসা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা নব্য জেএমবির সদস্য নাইমুজ্জামান নাইমকে গ্রেফতার করা হয়। নাইম নব্য জেএমবির ‘সিলেট আঞ্চলিক কমান্ডার’।
পরবর্তীতে নাইমের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার ভোরে পৃথক দুটি অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযানে গ্রেফতার করা হয় আরো চারজনকে। এর মধ্যে সিলেট নগরীর জালালাবাদ আবাসিক এলাকা থেকে সানাউল ইসলাম সাদী নামের একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এছাড়াও শহরতলির টুকেরবাজার এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় তিনজনকে। নাইম ও সাদী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গ্রেফতারকৃত বাকি তিনজন হচ্ছে- মির্জা সায়েম, জুয়েল, ও রুবেল। এই পাঁচ ‘জঙ্গি’ সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে হামলার পরিকল্পনা করছিলো বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পরবর্তীতে এই পাঁচ জঙ্গির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) রাতে পৃথক অভিযান চালিয়ে সিলেট নগরীর জালালাবাদ ও টিলাগড়ের শাপলাবাগ আবাসিক এলাকার দুটি বাসা থেকে বোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহৃত কম্পিউটার উদ্ধার করেছে পুলিশ ও র্যাব।
মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) রাত সাড়ে ৮টায় নগরীর জালালাবাদ আবাসিক এলাকার ৪৫/১০নং বাসার মুক্তিযোদ্ধা মইনুল আহমদের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। এসময় বাসা থেকে বোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম এবং কয়েকটি কম্পিউটার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত কম্পিউটারে বোমা তৈরির বেশকিছু ভিডিও ছিলো।
অপরদিকে, জঙ্গি নাইম ও সায়েমকে নিয়ে রাত সাড়ে নয়টায় নগরীর টিলাগড়ের শাপলাবাগ আবাসিক এলাকার ৪০/এ ‘শাহ ভিলা’ নামের বাসায় অভিযান চালায় র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। এসময় জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহৃত কয়েকটি কম্পিউটার জব্দ করা হয়।
এই দুই স্থানে অভিযান শেষে গ্রেফতারকৃত ৫ জঙ্গিকে ঢাকায় নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, সিলেটের টিলাগড় এলাকার শাপলাবাগের ‘সূর্য্য দীঘল বাড়ি’ থেকে ২০০৬ সালের ২ মার্চ স্বপরিবারে আটক করা হয়েছিল জেএমবি নামক জঙ্গি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আব্দুর রহমানকে। ‘সূর্য্য দীঘল বাড়ি’ থেকে শায়খ রহমানকে বের করে আনতে সময় লেগেছিল ৩ দিন। তার মাস ছয়েক আগে, একযোগে সারা বাংলাদেশের তেষট্টিটি জেলায় ৫শটি’র মত বোমা হামলা চালিয়ে চমকে দিয়েছিল এই জেএমবি।
ওই সময় র্যাব বাড়িটিকে ঘেরাও করে রেখেছিল আটাশে ফেব্রুয়ারি থেকে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সবাইকে জীবিতই আটক করা গিয়েছিল। শায়খ রহমানকে পরিবারের সব সদস্য-সহ বের করে আনতে প্রয়োগ করা হয়েছিল গ্যাস। ‘সূর্য্য দীঘল বাড়ি’র ছাদ ফুটো করে ক্যামেরা ঢুকিয়ে ভিতরের কর্মকাণ্ড অবলোকন করেছিল র্যাব সদস্যরা।
শায়খ রহমানকে তার নানাবিধ কর্মকাণ্ডের কারণে এর এক বছর পর ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ ফাঁসিতে চড়তে হয়েছিল।
২০০৬ সালে সিলেটের ওই অভিযানকেই মনে করা হয় বাংলাদেশের প্রথম বড় ধরণের জঙ্গিবিরোধী অভিযান। ওই ঘটনার চৌদ্দ বছর পর সেই শাপলাবাগ এলাকারই আরেক বাড়ি ‘শাহ ভিলা’ আবারও সিলেটবাসীর মানসপটে ভাসিয়ে তুললো ভয়ঙ্কর ‘বাংলা ভাই’ আর দু:স্বপ্নের ‘সূর্য্য দীঘল’কে।