ইকরামুল কবিরঃ বৈশ্বিক করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষায় ঘরে থাকার বিকল্প নেই। একথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দেশ-বিদেশের সব প্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রচারিত হয়ে আসছে করোনার আগ্রাসনের প্রথম থেকে এখনো। চলাচলে কিংবা কোথাও অবস্থানে সামাজিক দূরত্ন বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে প্রতিদিন। কেনাকাটা ও গণপরিবহনেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক, না পরলে শাস্তি-অর্থদন্ড (৬ মাসের জেল বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড) রয়েছে বিধিবিধানে। কিন্তু বাস্তবে কী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছো? আমরা যারা গণনাধ্যমে কাজ করি প্রায়ই প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করি স্বাস্থ্যবিধি না না মানার কারণে জরিমানা করতে দেখি। কিন্তু তাতেও কী লাভ হয়েছে? নগরবাসী কী তা মানছে?
সিলেট জেলার লোকসংখ্যা ৩৫ লাখ ৬৭ হাজারেরও বেশি আর সিলেট নগরীর লোকসংখ্যা ৮ লাখ ৬০ হাজারের মতো। এতো জনবসতির এই জেলা ও নগরীতে কে স্বাস্থ্যবিধি মানছে, কে মানছে না, তার খবর রাখা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। জনগণকেই সচেতন হতে হবে। প্রশাসন, সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব নয়। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তা-ই মনে হচ্ছে।
৫ এপ্রিল সিলেটে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়েছিলেন ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারি অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন। ওই দিনকে সিলেটের করোনা আক্রান্তের প্রথম দিন ধরে লকডাউন চলাকালে ৪০ দিনে ১৫ মে সকাল পর্যন্ত সিলেটে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৩। আর ওই দিন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন ৩ জন।
ঈদের কেনাকাটার জন্য সরকার লকডাউন তুলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শপিং মল ও দোকানপাট খোলার অনুমতি দেয়। সিলেট নগরীর ব্যবসায়ীরা করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় শপিংমল ও দোকানপাট না খোলার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে থাকেননি অনেক ব্যবসায়ী। ফলে, করোনাকে তুচ্ছ মনে করে ঈদের কেনাকাটায় মনোনিবেশ করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।
ঈদের কেনাকাটায় লকডাউন উঠে যাওয়ায় এবং লোকজন স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঈদের কেনাকাটায় ঝাপিয়ে পড়ায় করোনা থাবা বসায় সিলেটের ওপর।
ঈদের দিন সিলেটে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩১০ জনে আর মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় দশে। শুরু হয় করোনার ঊর্ধ্বগতির আক্রমণ। প্রথম দিন থেকে মে মাসের শেষে ৫৬ দিনে সিলেটে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫৫ আর মৃতের সংখ্যা ১৪-এ।
এই ধারা ভয়ঙ্কর রূপ নেয় জুন মাসে এসে।
জুন মাসের ২৬ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ২,২১৪। মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮ জনে। আগের ৫৬ দিনের হিসেব বাদ দিলে শুধু জুন মাসে করোনায় আক্রান্ত হন ১,৬৫৯ জন। আর জুন মাসে মৃত্যুবরণ করেন ৩৪ জন।
ঈদের পর থেকে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হঠাৎ লকডাউন তুলে দিয়ে ঈদের কেনাকাটাকে প্রধান কারণ মনে করছেন কোভিড ১৯ বিশেষজ্ঞরা। সরকার ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে মানবিক কারণে ঈদের আগে লকডাউন তুলে দিয়ে বিপণি বিতান ও দোকানপাট খোলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলো। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তা কেউ মানেনি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শত চেষ্টা ও জরিমানা করেও লাভ হয়নি। যার ফলে আক্রান্ত আর মৃত্যুর মিছিলে যোগ হতে থাকে নতুন নতুন মুখ। জুন মাসে প্রতিদিন গড়ে ৬৩ জনেরও বেশি আক্রান্ত হয়েছেন সিলেটে। আজ (২৬ জুন) ১২২ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
পরিশেষে বলতে চাই। অবহেলা আর অযত্নে ৮২ দিন অতিবাহিত করেছি আমরা। আর নয়। প্রশ্ন এসেছে লকডাউন হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যদি পাল্টা প্রশ্ন কেউ রাখনে, কালিঘাট, লালদিঘীর পাড়, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, আম্বরখানা ঈদের সময় স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে ব্যবসা করেছিলেন? বলবেন ক্রেতারা মানে নাই। তাইতো এখন একটি প্রশ্ন সবার মুখে মুখে ঘুরছে ‘জীবন আগে না জীবিকা আগে?’ তাই জীবন বাঁচাতে কঠোর লকডাউনের বিকল্প নেই । আর তা না হলে সিলেটের করোনা আইসোলেশন সেন্টার গুলোতে জায়গা হবে না। ভাবনাটা সুস্থ মানুষের। ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন।।
ইকরামুল কবির: সাবেক সভাপতি, সিলেট প্রেসক্লাব, সিলেট প্রধান সময় টেলিভিশন।