রোজার উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছেন, ‘রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক অভ্যাস থেকে মুক্ত করা এবং জৈবিক চাহিদার মধ্যে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠা করা।’
রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে। শারীরিক ও আত্মিক উন্নতি সাধন করে। বস্তুত রোজা মহান আল্লাহ ও তার বান্দার মাঝে এমন এক সেতু-বন্ধন, যা কেবল স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ককে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজাকে ফরজ করা হল, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’(সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
এ রোজা পালন শুধু একটা ফরজ আদায়-ই নয়। বরং মানবজীবনে রোজা পালনের সার্থকতা অনেক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের মাঝে কেউ যদি রমজান মাস পায় তাহলে সে যেন রমজানের রোজা রাখে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালনের মাধ্যমে মানবজীবনের প্রথম সার্থকতাই হলো মহান আল্লাহর আদেশ পালন করা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহ পাকের খুশি ও আখেরাতের সোয়াবের আশায় রোজা রাখে আল্লাহ তায়ালা তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেন।’ (বুখারি: ১/২৫৫)
এখান থেকে বুঝা যায় একনিষ্ঠ খালেছ নিয়তে রোজা রাখলে মহান আল্লাহ রোজাদারের পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন। অতএব বলা যায় রোজা পালনে মানবজীবনের আরও একটি সার্থকতা হলো, পূর্ববর্তী সব গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়া।
ইবাদতের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী শত্রুদের মাঝে নফসে আম্মারা অন্যতম। আল্লাহ তা’আলা বলেন- “নিশ্চয়ই নফসে আম্মারা মন্দ কাজের নির্দেশদাতা।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৩)
যে ব্যক্তি নফসে আম্মারাকে শায়েস্তা করতে পারে, সে অতি সহজেই ইসলামের বিধানাবলি পালন করতে পারে। নফসে আম্মারাকে শায়েস্তা করার জন্য রোজা একটি অব্যর্থ ওষুধ। ইমাম গাজালি রহ. বলেন, ‘নফসে আম্মারা সাপের মতো এবং রোজা এর প্রতিষেধক। তাই মানব জীবনে রোজা পালনের মাধ্যমে নফসে আম্মারা দমন করে ইবাদতে মনোযোগী হওয়া সম্ভব।’
রোজা শুধু রুহ বা আত্মার উন্নতি সাধন করে তা নয়। বরং দেহের সুস্থতারও বিশেষ সহায়ক। সে খবর আমরা অনেকেই রাখি না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সংগ্রাম করো, গনিমতের মাল পাবে। রোজা রাখো, সুস্থ থাকবে। সফর করো, অন্য থেকে অমুখাপেক্ষি থাকবে।’ (আত্তারগিব অত্তারহিব: ২/৪৯)
রোজা সুস্থ জীবন লাভে সহায়ক। কিন্তু অনেকেরই ধারণা তারা একদিন উপবাস থাকলেই সহজে রোগাক্রান্ত হয়ে যায়। কারণ তাদের জীবনীশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মতে সুস্থ জীবন লাভের জন্য খাওয়ার প্রয়োজন বেশি নয়। বরং কম ও পরিমিত খাওয়াই সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি। রমজান মাসে অন্য মাসের তুলনায় কম খাওয়া হয় এবং কম খাওয়া সুস্বাস্থ্যের অনুকূলে। বাংলায় একটি প্রবচন আছে, ‘বেশি বাঁচবি তো কম খা’ এটা বৈজ্ঞানিক সত্যে উত্তীর্ণ।
রোগ নিরাময়ের যতগুলো প্রতিকার এবং প্রতিষেধক আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ প্রতিকার হল রমজানের রোজা। ডা. জয়েলস এম ডি বলেছেন, ‘যখনই এক বেলা খাওয়া বন্ধ থাকে, তখনই দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগ মুক্তির কাজে নিয়োজিত করে। অধিক ভোজনের ফলে যে বিষক্রিয়া উৎপন্ন হয়, তা দেহের স্নায়ুকোষকে বিষাক্ত করে দেয়। ফলে দেহে এক অস্বাভাবিক রকমের ক্লান্তিবোধ এবং জড়তা নেমে আসে। যখন আমরা আহার বন্ধ করে রাখি এবং দেহযন্ত্রকে বিরতি দেই, তখন দেহে সংরক্ষিত জীবনী শক্তিতে প্রচণ্ডবেগে সঞ্চারিত হয়। রোজা দেহযন্ত্রের বিরতিকালে শরীরের অপ্রয়োজনীয় অংশ ধ্বংস করে এবং দেহের রোগ নিরাময় কাজে সংরক্ষিত প্রাণশক্তির সদ্ব্যবহার করে।
ড. ডি ডিউই বিশেষ জোর দিয়ে বলেছেন, ‘রোগ জীর্ণ এবং রোগ ক্লিষ্ট মানুষটির পাকস্থলী হতে খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে ফেলো, তাহলে দেখবে ‘রুগ্ন মানুষটি’উপবাস থাকছে, না সত্যিকাররূপে উপবাস থাকছে ‘রোগটি’?
চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক ডা. হিপ্রোক্রাটস বহু শতাব্দী পূর্বে বলেছেন, ‘অসুস্থ দেহে যতই খাবার দিবে, ততই অসুস্থতা সাড়তে থাকবে।’
পূর্ণ একমাস রোজার ফলে জিহ্বা ও লালা গ্রন্থিগুলো বিশ্রাম পায়, ফলে এগুলো সতেজ হয়। যারা ধুমপান করে তাদের জিহ্বায় ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগ হবার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই একমাস রোজার সময় ধুমপায়ীরা ধুমপান কম করে বলে উক্ত আশঙ্কাজনক রোগের সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। তাছাড়া একমাস রোজার ফলে জিহ্বায় খাদ্যদ্রব্যের স্বাদও বৃদ্ধি পায়। এটা বিশেষ করে তাদের জন্য যারা অত্যধিক ধুমপান করে ও পান খেয়ে জিহ্বায় খাদ্যদ্রব্যের স্বাদ হারিয়েছে।
রোজা রাখার মাধ্যমে পাকস্থলী ও অন্ত্র পূর্ণ বিশ্রাম পায় এবং লুপ্ত শক্তি পুনরুদ্ধারের সময় পায়। পেপটিক আলসার এবং তদজনিত ফুলা রোগ এবং প্রদাহ রোজার কারণে তাড়াতাড়ি উপশম হয়। রোজা পরিপাকতন্ত্রের জীবাণুর পচনশীলতা দূর করে এবং রোজা রাখার মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্র জীবাণুমুক্ত থাকে।
রোজা মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে উজ্জীবিত করে। এতে ধ্যান ধারণা পরিষ্কার ও সহজ হয়। মস্তিষ্কে মুক্ত রক্ত প্রবাহ এবং সূক্ষ্ম অণুকোষগুলোকে জীবাণুমুক্ত ও সবল করে। এর ফলে মস্তিষ্ক অধিক শক্তি অর্জন করতে পারে। জ্ঞানীগণ যথার্থ বলেছেন, ‘ক্ষুধার্ত উদর জ্ঞানের উৎস’।
ডা. এলেক্স হেগ বলেছেন, ‘রোজায় মানুষের মানসিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতি গুলো উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তি শক্তি পরিবর্ধিত হয়। প্রীতি-ভালোবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি প্রভৃতি বেড়ে যায়। রোজা খাদ্যের অরুচি ও অনিচ্ছা বিদূরিত করে। রোজা শরীরের রক্তের প্রধান পরিশোধক। দেহে রক্তের পরিশোধন এবং বিশুদ্ধির মাধ্যমে দেহ প্রকৃতপক্ষে জীবনীশক্তি লাভ করে।
শারীরিক কতগুলো ব্যাধির উৎসের অথবা বৃদ্ধির আংশিক অন্যতম কারণ হচ্ছে- মানসিক অশান্তি-পীড়া। এদের বলা হয় সাইকো সোমটিক ব্যাধি। একজন মানুষ যদি প্রতি বৎসর এক মাস নিয়মিত রোজা রাখে তবে বহুমূত্র, উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি হৃদরোগ এবং মাসিক ঋতুর গোলযোগসহ বহু সাইকো সোমটিক ব্যাধির উপসর্গ হতে মুক্তি পেতে পারে। কেননা রোজায় মানুষের মানসিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়।
রোজার বিকল্প কোনো ইবাদত নেই। এর দ্বারা রুহ বা আত্মা, দেহ ও সমাজ প্রত্যেকেই উপকৃত হতে পারে। ব্যক্তির নৈতিক উন্নয়নের জন্য রোজা অত্যাবশ্যক বা ফরজ। নফল রোজা রাখতে না পারলেও ফরজ রোজা ত্যাগ করবেন না। মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ফতওয়া-গবেষক ও টেলিভিশনে ইসলামবিষয়ক ভাষ্যকার