এখন কারও করুণ দৃষ্টি তাকে কাবু করতে পারে না। রিনি দুচোখ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়। বিছানার উপর বড় এক স্যুটকেস। সেখানে মোটামুটি সবকিছু নেয়া হয়ে গেছে। মঈন ভোর রাতে প্যাকেটে ভরে দিয়েছে একুশ ইঞ্চি টেলিভিশন। দরজার সামনে বারান্দায় পড়ে আছে ওটা। রিনি কী করবে? তার এসবে কোনো প্রয়োজন নেই। কে শোনে কার কথা! মঈন তখন জোর করে হাতে কুড়ি হাজার টাকা তুলে দেয়। রিনি এর জন্যও প্রস্তুত ছিল না। এখন বুঝতে পারে, সবকিছুর ইতি হয়ে গেছে। এবার চলে যেতে হবে। সে যেতে চায় না। কেন যাবে? জানা নেই কোনো কারণ। যতটুকু বোঝে তা ঠিক নয় অথবা যে বোঝে সে ঠিক বোঝে কিনা কে জানে, সে নিজে বোঝে না…জানে না। হয়তো জেনেও তার ভুল শোধরানো অসাধ্য। সে চেষ্টা করেছিল। সকল দায়ভার নিজের কাছে জমা নিয়ে অনেক অনুনয় আর দুহাত চেপে আকুতি রেখেছে। নিষ্ফল রাতের মতো সব ব্যর্থ। অবশেষে যা হওয়ার ফয়সালা মধ্য রাতে হয়ে গেল। মঈন বলে দিয়েছে শেষ কথা। এর পর আর কোনো কথা থাকতে পারে না ।
সকালে রিনি তবু শেষ চেষ্টার মতো আরও একবার খুব কাছে এগিয়ে গেল। এই কয়েক মাসে লোকটিকে কত আপন করে নিয়েছে। আজ একেবারে অচেনা…প্রচণ্ড অজানা মনে হতে থাকে। সে তার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মঈন মুখ ফিরিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। রিনির ইচ্ছে হয় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। পারে না। কোত্থেকে এক জড়তা তার সে ইচ্ছের টুঁটি চেপে ধরে। তার নিঃশ্বাস মঈনের কাঁধ স্পর্শ করে যায়। মঈন একবার পেছন ফিরেও তাকায় না। কঠোর দুটো চোখ জানালার বাইরে ছড়িয়ে হয়তো কোনোকিছু দমনের চেষ্টা করে। রিনি কী করে বোঝাবে সে মঈনকে ঠকায় নি। এমন এক সময় আর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে বা হতে হবে কল্পনাও তার ছিল না। সে প্রায় বিবশ হয়ে যায়। তারপর হয়তো শেষবার ইচ্ছে করে মঈনের কাঁধে হাত রাখে। নিজের মুখ আর গাল তার পিঠে স্পর্শ করে দেয়। পারে না। গতরাতে সবকিছু চুকে গেছে। কি দুঃসহ আর ভয়ংকর রাত ছিল কাল!
‘একটা শেষ কথা বলি?’ ‘আর কী কথা থাকতে পারে রিনি? তোমরা আমাকে ঠকিয়েছ। সারা জীবন প্রতারিত হয়ে আপোষ করতে চাই না। আর আমি এমন মহৎ ব্যক্তি নই যে সবকিছু মেনে নিয়ে চলব। সব ফিনিশ হয়ে গেছে।’
রিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। এ ছাড়া আর কী করার আছে তার? ছয়-সাতটি মাস এক স্বপ্নের ঘোরে কেটে গেল। কত আপন করে জেনেছে মঈনকে। নিজের মানুষ…স্বামী। সারা জীবন এর সঙ্গে সঙ্গে চলার এক বন্ধনে আবদ্ধ। তার সুখ-দুঃখে জীবন ভেলায় ভাসতে হবে এই তো জানা আর বিশ্বাস। কোনোদিন দুঃস্বপ্ন দেখে নি প্রাণপ্রিয় মানুষটি তাকে ভাসিয়ে দেবে এক অনিশ্চিত জীবনে। অথচ কী দোষ? কোনো দোষ নেই। সেটি তেমনকিছু নয় অথবা হয়তো তার চোখে এক অপরাধ। সে ভয় তো তার ছিল না, মা-বাবার। তাই বিয়ের সময় রাজাকে সরিয়ে রাখা হয়। রিনির খারাপ লেগেছে। আদরের ছোট ভাই। বোনের বিয়েতে কত আনন্দ করবে। গান গাইবে…নাচবে। অকারণ ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করবে। দুচোখে আনন্দের ঢেউ তুলে খুশিতে উদ্বেল হবে। সে আর হলো না। হবে কী করে? উপায় নেই। তাকে দূরে সরে থাকতে হলো। রিনির আপত্তি জোর পেল না। মা-বাবা যখন বুকে পাথর বেঁধে সরিয়ে রাখতে পারে, সে তাই…। তার বুক ভেঙে যায়। রাজার উজ্জ্বল হাসি-মাখা দুচোখে তাকিয়ে তার চেহারা শুধু মলিন হয়ে যায়। এই জীবন সংসারে কতকিছু চুপচাপ সহ্য করতে হয়। রাজা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সব বোঝে। তাই কোনো আপত্তি করে না। ছায়াম্লান মুখে এক টুকরো হাসি টেনে বলে, –
‘বুবু তোর শ্বশুরবাড়ি যাব, আগে বিয়ে হোক। সেদিন দুলাভাই লোকটিকে দেখেছি। তোকে দেখতে এলো। আমি পুকুরপাড়ে কুল গাছের আড়ালে ছিলাম; ভালো লোক। সুন্দর দেখতে। ফর্সা চেহারা, ঠোঁটের উপরে চিকন গোঁফ। ভেরি হ্যান্ডসাম। তোর সাথে খুব মানাবে। দেখিস আমি তোর বাড়ি যাব। অনেককিছু রেধে খাওয়াবি কিন্তু।’
রিনির দুচোখে এক শূন্যতা। সে কী বলবে? শুধু মৃদু হেসে দুচোখের জল লুকোতে জানালার বাইরে দৃষ্টি পাঠিয়ে দেয়। তখন ঘরের ভেতর আলোছায়া অন্ধকার উঠোনে নেমে আসে। সন্ধে হয়ে আসছে। বাবা আঙিনা থেকে তাড়া দেয় আর একবার। হাতে সময় কম। অনেক দূর যেতে হবে। রাজা থাকলে অনেক কষ্ট করে ঠিক করা সন্বন্ধ ভেঙে যেতে পারে। সকলে মুখে মুখে এমন মানুষের প্রতি করুণা করে, বাস্তব বড় ভিন্ন। কেউ তেমন ঘরে আত্মীয়তা করতে চায় না। কাজটি ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে অন্য কথা। বিয়েতে কত কথা হয়, কত লুকোচাপা চলে; কে তার মনোযোগ দেয়! তারপর একসময় সবকিছু থিতু হয়ে আসে। দুটো মানুষের মিলন ভেলায় তখন সব বাসি। একদিন রাজা ঠিক তার বাড়ি যাবে। অনেক আদর করে ছোটভাইকে কাছে রাখবে সে। তখন নিজের মানুষও বুঝে নেবে সবকিছু। রিনি এ রকম ভাবনায় কোনো দোষ পায় নি। অথচ কি হতে কী হয়ে গেল!
রাজা এক সপ্তাহের জন্য ফুপু বাড়ি চলে যায়। সেখানে দেখার লোক আছে। বিয়ে বাড়িতে যা যা রান্না হয়, সবগুলো সেখানেও হলো। কোনো সমস্যা নেই। এদিকে ঠিক ঠিক বিয়ের কাজ শেষ হলো। এ তো ঠিক রাজকন্যের বিয়ে। কত আনন্দ আর খুশির ফোয়ারা। সকলের সুখী মুখ…উজ্জ্বল চেহারা। রিনি শুধু এক কৃত্রিম আনন্দ চেহারায় সাজিয়ে নেয়। তার বুকের ভেতর থেকে থেকে এক কান্না দমকা বাতাসের মতো ঢেউ তোলে। অবাধ্য মন রাজার কথা ভাবে। তখন মন অকারণ উদাস হয়ে যায়। বেশ কষ্ট করে বুক ভরা বিষণ্নতা দুচোখের পাতায় রোধ করে গেছে। তবু কি পোড়া মন সব বারণ মানে? যখন সন্ধে রাত, শহরে এসে এক ঘরে বসতে হয়; কত সুন্দর করে সাজানো। তাজা ফুলের সৌরভে ভরে আছে সব। নানা রঙের এলুমিনিয়ম কাগজে ঝুমঝুম করছে এক অদ্ভুত মাদকতা। সে খুব আড়ষ্ট এক প্রান্তে বসে পড়ে। তখন সকলে নতুন বউকে স্বাগত আর অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। সেই ফাঁকে কেউ একজন বলে উঠে, –
‘সে কি ভাই, নিজের বাড়ি এসে কেউ এমন মুখ ভার করে বসে থাকে? তোমার কি খারাপ লাগছে?’ ‘ন্-না অনেক দূর থেকে এসেছি তো!’ ‘কেন মাইক্রোতে চড়ার অভ্যেস নেই? বমি করেছিলে?’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ একবার তেমন কাণ্ড করেছে বইকি!’
মঈন কথা বলে হতবাক হয়ে পড়ে। বর মানুষ মুখ খোলে কেন? একে তো লাজুক, আজ হলো কি! তখন সকলের মুখে চাপা হাসি আর ঠাট্টা। কেউ কেউ ফোঁড়ন কাটে।
‘বাব্বা এখনো চব্বিশ ঘন্টা পেরোয় নি, বউয়ের সব দিকে নজর পড়েছে!’ ‘আমি আর কথা বলব না।’ ‘আমাদের সাথে আর কি তুমি কথা বলবে? এখন সঙ্গী পেয়েছ।’ ‘না তোমরা বড্ড বাজে বকো।’ ‘চল রে আমরা বড় বাজে!’
রিনি তখন মনে মনে নতুন লোকটিকে নিজের, একেবারে আপন করে নিয়েছে। এমন সুপুরুষ আর মৃদুভাষী মানুষ তার স্বামী। এর সঙ্গে তার সারা জীবন চলার পথ। সে অপাঙ্গে একপলক তার দুচোখে চোখ রাখে। শিহরিত হয়। নতুন দিনের স্বপ্নেরা ভাবনায় খেলা করে। সেদিন থেকে মঈন তার স্বপ্ন। একান্ত নিজের পুরুষ। তার বুকে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যায়। তার সুখের জন্য সকল আবদার নির্দেশ মাথা গুজে মেনে চলে। আজ মনে হয়, সকলি গরল ভেল। একেবারে অন্য একটি দিন আজ। সে এক গভীর সুখ স্বপ্ন ঘুমঘোরে আঁকা ছিল, ভেঙে গেছে। সে জানে না, কোনোদিন সেখানে আবার কোনো মিলনের গান বেজে উঠবে কিনা। সে বলে, –
‘আমি জানতাম, তুমি সব জেনেশুনে এগিয়ে এসেছ।’ ‘জানলে দশ লক্ষ টাকা যৌতুক দিলেও তোমাকে বিয়ে করতাম না। দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছে? কত অভিভাবক পেছনে ছিল জানো?’ ‘সে তো বটেই! আমরা হলাম দাসি বাদি। একজনের উপর নির্ভর করে নিজের জীবন কাটিয়ে দিই। তার ঘরদোর ঝাড়ু দিই, কাপড় কাচি, রান্না করি, সবকিছু সামলাই; তারপর আরও কতকিছু করতে হয়; শুধু একমুঠো খাবারের জন্য।’ ‘খাবারের জন্য নয় রিনি। ভালবাসা আর বিশ্বাস থাকতে হয়।’ ‘আমি তো তোমার বিশ্বাস ভেঙে দিই নি। মন প্রাণ দিয়ে তোমার বুকে মাথা রেখেছি। আমি…।’ ‘তুমি কথা ঘুরিও না বুঝলে। তোমরা এক চিট ফ্যামিলি…আমাকে ঠকিয়েছ। তোমার সাথে আমার আর থাকা চলে না। অল আর ফিনিশড্।’
রিনি কী বলবে? কথা বললে বেশি বলা হয়। তর্ক করা বোঝায়। সে চুপ করে থাকে। ভেবে নেয়, দুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। দিন কয়েক আগে রাজা আর মা’কে বিকেলের বাসে তুলে দিয়েছে। সে জানত না, বাড়িতে মেহমান এলে রেগে যায় মঈন। এই কয়েকটি দিন বেশ রাশগম্ভীর হয়ে থেকেছিল। যে লোকটি রাতে কত প্রগলভ হয়ে যায়, কোনো শব্দ করে নি। কত আদর করে বুকে চেপে রাখে, স্পর্শ করে নি। নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। রিনি এসবের অর্থ খুঁজে পায়, আবার হয়তো খুঁজে পায় না। সে বোকার মতো জিজ্ঞেস করে বসে, –
‘তোমার মন খারাপ? মাথা ধরেছে? টিপে দেব?’ ‘না কিছু হয় নি, তুমি ঘুমোও।’ ‘অফিসের কোনো ঝামেলা? এই কথা বলছ না কেন? আমি কি কোনো দোষ করেছি?’ ‘কিছু হয় নি রিনি, তুমি ঘুমোও।’ ‘আমার মা আর ভাই এসেছে বলে রাগ করেছ? ওরা সোমবার চলে যাবে। দুটো দিন। মেয়ের বাড়ি তো মা-বাবা খুব একটা আসে না। বোনের বাড়িতে ভাই আসতে তো তেমন বাধা নেই। তুমি কি রাগ করেছ?’ ‘না।’
মঈন তখন পাশ ফিরে এক তেপান্তর দূরত্ব মেপে নেয়, রিনি তার নাগাল পায় না। তার ভয় লাগে। সে রাতের আলোছায়া দেয়ালে দৃষ্টি মিশিয়ে ভাবতে থাকে, এত কাছের লোকটি কেমন করে কোন্ কারণে অচেনা হয়ে যায়। সারারাত সে জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর পায় না। রাত ধীরে ধীরে আরও গভীর অন্ধকার আর নিস্তব্ধ হতে থাকে। তার ভাবনা এক অস্থির জিজ্ঞাসা হয়ে অদৃশ্য গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলে। তারপর ভোর হয়, আলো ফোটে; তার কোনো সকাল হয় না। শুধু এক অবরুদ্ধ যন্ত্রণায় দুচোখ জ্বালা করতে থাকে আর মুখ চোখ ভার হয়ে আসে।
দিন কয়েক আগের ঘটনা। রিনি কোনোদিন ভাবে নি, তারা আসবে। দরজায় শব্দ শুনে সে খুব সাবধানে দাঁড়ায় আর প্রচণ্ড এক বিস্ময় শব্দ কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে। সেখানে আনন্দ আর আহলাদি সুরের এক যুগলবন্দি হয়ে যায়।
‘মা তোমরা…কি অবাক কাণ্ড! আমি তো ভেবেছিলাম, মেয়ে বিদায় দিয়ে প্রাণে বেঁচে গেছ; আর আসবে না। রাজা তুই কেমন আছিস ভাই আমার?’ ‘বুবু তোর বাড়ি দেখতে এলাম। রাগ করবি না তো?’ ‘ও মা এ কি কথা? তুই আমার বাড়ি আসবি না? নিষেধ করেছে কে?’ ‘দুলাভাই যদি রাগ করে?’ ‘কিছুতেই নিষেধ শোনে না রিনি, তোকে দেখার সাধ হয়েছে।…হ্যাঁরে শেষে জামাই কিছু মনে করবে না তো?’ ‘না মা সে লোক বেশ ভালো মানুষ।’
রিনি কথা বলেই রাঙা হয়ে ওঠে। দুপুরের উজ্জ্বল আলো তার গালে পিছলে ছড়িয়ে যায়। এত সহজে এ কথা বলতে গেল কেন? সে আসলে নিজেকে সামাল দিতে পারছে না। কত দিন পর মা আর ভাইকে দেখছে। বিয়ের পর কয়েকটি মাস একাধারে চলে গেল, তেমন করে বাবার বাড়ি যাওয়া আর থাকার সুযোগ হয়ে ওঠে নি। শহরে বাসা বদল, নতুন করে সাজানো: মঈনের অফিসের কাজ নানান ব্যস্ততা লেগেই আছে। যে দু-একবার গিয়েছে, একা; মঈনের সময় নেই। সে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। টিকিট কেটে সিটে বসিয়ে দুটো কথা বলে। বাস রওয়ানা দেয়ার আগে খুব নিঃসঙ্গ উদাস হয়ে নামে। কাউন্টারের এক পাশ দাঁড়িয়ে বিষণ্ন দুচোখ মেলে হাত নাড়ে। তারপর ধীরে ধীরে সে দূরত্ব দিগন্তে মিলিয়ে যায়। রিনি তখন চুয়াল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা বাইরের ফসলের ক্ষেত গাছপালা বাড়িঘর আর অচেনা মানুষজন দেখতে দেখতে শেষ করে। মঈনের জন্য ভাবে। লোকটির একা একা কষ্ট হবে। কে রেধে দেবে, কী খাবে ইত্যাদি। এসব ভাবতে ভাবতে বাজারের বাসস্টপে নামে। একটি ভ্যান বা রিকশায় ওঠে। তার চোখে-মুখে একদিকে আনন্দ অন্যদিকে প্রিয় মানুষকে ছেড়ে আসার বিষাদ খেলা করে তখন। বাড়ির আঙিনায় পা রেখে সনাতন জিজ্ঞাসার মতো শোনে।
‘তুই একাই এলি? জামাই এলো না?’ ‘ও ব্যস্ত মানুষ। দুদিন পর ঢাকা যাবে কোন কাজে। আমি সপ্তাহখানেক থাকব।’ ‘একবার ধরে নিয়ে আসবি। আমাদের কি সাধ-আহলাদ নেই?’ ‘তোমরা ধরে আনো না কেন?’ ‘আমি ধরে নিয়ে আসব বুবু।’
তখন এক করুণ দৃশ্যের সূচণা হয়। রিনি খুব সহজে তা ডিঙিয়ে আসে। সে দ্রুত রাজার কাছে গিয়ে হাসিমুখে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। সঙ্গে আনা মিষ্টি কিংবা বিস্কুটের প্যাকেট এগিয়ে ধরে। রাজা একটি হাত বাড়িয়ে দেয়। অন্য হাত এগিয়ে দিতে পারে না। সে হাতটি খুব ছোট, হয়তো অন্যকোনো শিশুর; সেখানে একদম শক্তি নেই। রাজার নাক আর মুখের এক পাশ বাঁ দিকে বাঁকা হয়ে থাকে। জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী একটি ছেলে যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। অবলম্বনহীন অবলম্বনের বেঁচে থাকায় কোনো স্বস্তি সুখ নেই। অথচ ঠোঁটের কোণায় এক অপার্থিব হাসি আর আনন্দ সবসময় লেগে আছে। এই নিয়ে তার বেঁচে থাকা। সে এত খুশি খুশি চেহারা কীভাবে ধরে রাখে? রিনির বুকে এক বেদনার ধাক্কা লাগে। মনের মধ্যে এক বিষম হোঁচট। রাজা যদি স্বাভাবিক থাকত, কত মজা হতো!
সেদিন দুপুরে তেমন অস্বস্তি আর অস্থিরতার এক দমক ভাবনা তাকে কুরে কুরে খেতে থাকে। সে যা ভেবেছিল, মঈনের দুচোখে অবিশ্বাস আর অভিব্যক্তিহীন এক প্রচ্ছদ মূক-রূঢ়তায় তীব্র রহস্যময় হয়ে ওঠে। বিকেলের চেয়ে রাতকে আরও ভারী আর গম্ভীর করে তোলে। সবশেষে এক অচেনা গলার জিজ্ঞেস কিংবা প্রশ্নবাণ।
‘রাজা কি জন্ম থেকে এ রকম? আমি জানি না তো!’ ‘তাকে তুমি দেখ নি। সব উপরওয়ালার ইচ্ছে। সে কিন্তু খুব ভালো ছেলে। তোমাকে খুব ভালবাসে।’ ‘কই আগে কোনোদিন বলো নি তুমি।’ রিনি মশারি গোছাতে গোছাতে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। কোনো শব্দ করতে-কথা বলতে সাহস আসে না। তারপর একই প্রশ্নের দ্বিতীয় উচ্চারণ শুনে মুখ তুলে তাকায়।
‘এ আবার বলার মতো কোনো কথা হলো?’ ‘আমাকে কিন্তু জানানো হয়েছিল, তুমি একমাত্র সন্তান। সে তবে মিছে কথা। আমাকে মিথ্যে বলা হয়েছিল। কেন তোমরা এমন করলে?’ ‘কে বলেছে তোমাকে?’ ‘কেন হাফিজ চৌধুরি তো তেমন করেই বলেছিল। ব্যাটা বাস্টার্ড বারোভাজা লোক…মিথ্যেবাদী।’ ‘তুমি রেগে যাচ্ছো। বিয়েতে কতরকম কথা হয়, যাঁচাই করে নেবে না? আমিও তো অনেক কথা শুনেছি। কোনোদিন কোনো অভিযোগ করেছি?’ ‘কী কথা শুনেছ রিনি? আমি ফ্রড লোক? দুই নাম্বার…মিথ্যেবাদী?’ ‘সে কথা থাক। তুমি আমার নিজের লোক। কোনো অভিযোগ নেই।’ ‘কেন বলো, তোমার অভিযোগ বলো শুনি।’ ‘আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি কোনোকিছু আমার মধ্যে দেখেছ?’
মঈন অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরের সাদা দেয়ালে ফাইভ ওয়াটের হাল্কা নীল আলো শীতল রহস্য ছড়িয়ে দেয়। রিনির বুকের ভেতর এক অনতিক্রম্য অস্থিরতা। সে মঈনের দুচোখে কিছুক্ষণ অপলক স্থির। দেখে দৃষ্টির ভেতর এক অবিশ্বাসের সুড়ঙ্গ তৈরি হয়ে চলেছে। সেখানে এক গভীর খাদ, কাদার মতো এক চোরাবালি; সে ওই চোরাবালিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। সে হাতে-পায়ে চমকে ওঠে। তারপর খুব দ্রুত মঈনের দিকে এগিয়ে যায়। তার একটি হাত খুব আবেগে চেপে ধরে। দুচোখে চোখ রেখে গাঢ় স্বরে বলে উঠে, –
‘অনেক রাত হলো ঘুমোবে না?’ ‘তুমি শুয়ে পড়ো।’
মঈন তেমন কথা বলে নি। যেদিন তার অফিসের কাজ বাসায় নিয়ে আসে, গভীর রাত পর্যন্ত টেবিলে ছড়িয়ে রাখা ফাইলে মাথা গুজে দেয়; সে রাতে টুক করে রিনির গালে এক চুমো এঁকে মৃদু হাসে। বলে উঠে তেমন এক আবেগের কথা। রিনি তখন শুয়ে শুয়ে তার কাজ দেখে। দেখতে দেখতে এক সুখস্বপ্নে বিভোর হয়। একসময় ঘুমঘোরে বুঝতে পারে, গভীর রাত; লোকটি তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। সে খুব পরম বিশ্বাসে নিজেকে সঁপে দেয়। গত রাতে তেমন কিছু হয় না। দুজনের মাঝে এক বিশাল দূরত্ব তৈরি হতে থাকে আর রাত অজানা গন্তব্যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়।
রিনির দুচোখ ঘরের বারান্দা আর ছোট্ট আঙিনা পেরিয়ে টিউবওয়েলের ধার ঘেষে ঘুরে আসে। সবকিছু আজ অনর্থক। একটি শিম গাছের চারা লাগিয়েছিল। যত্ন করে মাচান বেঁধেছে। সেই উঁচুতে এখন বেগুনি ফুলের মেলা। সেদিকে তাকিয়ে কত মুহূর্ত আনমনা থেকেছে। কত ভালো লেগেছে তার! আজ কোনোকিছু ভালো লাগে না। মা আর রাজা চলে যাওয়ার সাত দিন পেরিয়ে গেছে। এই কয়েকটি দিনে প্রতি মুহূর্তে নীরবতার যে দুর্লঙ্ঘ দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, গতরাতে ভেঙে পড়েছে আকস্মিক ঝড়ের মতো। সে কত কথা বলে গেছে। কত অনুনয় অনুরোধ। মঈন ছাড়া তার আছে কে? কোথায় যাবে? কে দেবে আশ্রয়? তখন নিজের মানুষটি এক পাথরের মূর্তি। কোনো কথা বলে না। কোনো জবাব দেয় না। সেই একটি কথা বলে একেবারে নিশ্চুপ। সে যখন তার জন্য রিকশা ডেকে আনে, রিনি বারান্দায় স্থবির। তার দুটো পা কোনোকিছুর সঙ্গে আটকে গেছে। সে একবার চিৎকার করে বলতে চায়, ‘আমি যাব না’। পারে না। অবশেষে সেই পরম পাথরের কাছে এসে দাঁড়ায়। মুখের কাছে মুখ এনে অস্ফুট ফিসফিস করে, –
‘তোমাকে জানাই নি, ভেবেছি তুমি নিজে বুঝতে পারবে…আমি তোমার সন্তান নিয়ে যাচ্ছি।’
রিনি ভেবেছিল, শেষ এই অস্ত্র হয়তো তার মন গলিয়ে দেবে। আকুল করা দুহাতে তাকে ফিরিয়ে নেবে। তেমনকিছু হয় নি। সে খুব অনিচ্ছুক পায়ে রিকশায় ওঠে। বুকের ভেতর অস্থিরতার ঢেউ। দুটি চোখ অসম্ভব শুষ্ক। সমস্ত রাস্তা আনমনা। মানুষের কোলাহল পেরিয়ে বাসস্ট্যান্ড আসে। কাউন্টারে টিকিট কেটে খুব স্বাভাবিক সিটে বসে যায়। তারপর বারবার তার উন্মুখ দুচোখ পেছনে কাউকে খুঁজতে থাকে। মঈন আজ আসে নি; আসবে না। সময় হলে বাস ছেড়ে দেয়। সে তখন জানালা দিয়ে বাইরের সবকিছু দেখতে দেখতে নিজের দুচোখ গলিয়ে ফেলে। ঝাপসা হয়ে যায় সবকিছু। হায় জীবন!
রিনি ভেবেছিল তার গল্প শেষ হয়ে গেছে। যেভাবে শত শত নারীর পরনির্ভরশীল প্রতিবন্ধী জীবন চলতে চলতে একদিন থেমে যায়, সেও তেমন হাজার ভাবনায় কাটিয়ে দিয়েছে অনেক রাত। কোনোদিন ঠিক করে, শরীরের ভার নেমে গেলে নিজের জন্য কাজ খুঁজে নেবে। একটি ছোট চাকুরি খুঁজে পেলে সেখানে ডুবে গিয়ে ভুলে যাবে সকল স্বপ্ন-স্মৃতি। আসলে ভুলতে পারবে কি না অথবা জীবনে এমন অনেককিছু ঘটে যায়, শত চেষ্টাতে মুছে যায় না এও ঠিক; তবু বাঁচতে তো হবে। নিজের জন্য আর অনাগত সন্তানকে দেখাতে হবে জীবনের সহজ সরল রাস্তা। সে রাতের আলোছায়া দেয়ালে হাজার ভাবনায় দোল খেতে খেতে নিজেকে শক্ত করে নেয়। তখন আরও একবার মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা।
কোনোদিন বিষণ্ন মুখে বাড়ির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায় নি। সেদিন তাই হলো। বাড়িতে মেয়ে এলে মা-বাবা খুশি হয়। আনন্দে চকচক করে ওঠে দৃষ্টি। প্রাণের বাধভাঙা উন্মাদনায় প্রগলভ হয়ে যায় সময়। কিন্তু সেদিন তাদের চেহারায় উদ্বেগ আর আশঙ্কার ছায়া ঘনীভূত হয়ে ওঠে। রিনির উদভ্রান্ত মুখ দেখে হয়তো অনেককিছু ভেবে নেন। তারপর এক নিশ্চুপ প্রলম্বিত সময়। সন্ধের আগে আগে গোধূলি আকাশ জুড়ে হিমশীতল বাতাস ছড়িয়ে যায়। রিনির উদাস চেহারার গল্প শুরু আর শেষ হয় তখন। সে আর যাবে না। যে লোক একবার খুব সহজে সবকিছু অস্বীকার করতে পারতে পারে, তার মনে কোনো ভালবাসা নেই। সম্পর্ক তো প্রাণের টানে গড়ে ওঠে। কারও শারীরিক ত্রুটি সেখানে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। রিনি আর রাজার সম্পর্ক রক্তের সঙ্গে প্রাণের মিলবন্ধন আর মঈন তার জীবনচলার সঙ্গী। পথযাত্রায় কেউ হারিয়ে যেতে পারে, যদিও তা খুব বেদনার। রিনি সেই বেদনা হাসিমুখে সইবে।
কয়েক মাস পর বাড়ির আঙিনায় এক রিকশা এসে দাঁড়ায়। তখন সকালের সূর্য কিছু উপরে উঠে গেছে। পুকুর পাড়ের সোনালু ফুলে ফুলে এক অদ্ভুত দীপ্ত প্রভা। রিনি সামনে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে যায়। অনেক বদলে গেছে মঈন। চোখে-মুখে এক বিষণ্ন কৃষতার প্রলেপ। তার বুকে এক দমকা হাওয়া লাগে। এক বিষাদ গানের সুর। সে দ্রুত ঘরের ভেতর চলে যায়। দক্ষিণ কোণায় এক ছোট দোলনা। সেখানে দাঁড়িয়ে খুব আনন্দে তার কিছু বলতে ইচ্ছে করে। দোলনার কোলে এক শিশু। পরীর মতো সৌন্দর্য নিয়ে ঘর আলোকিত করে আছে। তার চিকন ঠোঁটে অজানা জগত দেশের রহস্যময় এক চিলতে হাসি। রিনি সেদিকে তাকিয়ে খুব বেশি অস্থির হয়ে যায়। লোকটি অবশেষে এলো। প্রগাঢ় আবেগ আর অভিমান তার দুচোখ সজল করে দিতে থাকে। কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে! তারপর আঁচলে দুচোখ মুছে সে খুব সহজে বের হয় বারান্দায়। দেখে মঈন চেয়ারে বসেছে। তার বাঁ পাশে চৌকির উপর বাবা। একটু দূরে দক্ষিণে রান্নাঘর, দরজার পাশে রাজা। তার বাঁকা মুখে এক অপার্থিব দুষ্টুমির হাসি। সেখানে শুধু সরলতা। কোনো অভিযোগ কোনো দাবি কোনোকিছু নেই। সে যেন অনেক প্রতীক্ষায় বসেছিল, কেউ একজন আসবে আর সেই প্রিয়জন তার আঙিনায় এসেছে। রিনির দৃষ্টি সেখানে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। রাজার কোনো রাগ বা অভিমান নেই। শুধু তার বুকে এক বিছুটি দংশন। এক অস্থিরতা। সে সামনে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকে। তার দৃষ্টি খুব কোমলভাবে মঈনের চোখে পড়ে। অবরুদ্ধ আবেগ এসে দুর্বল করে দিতে চায়। কিন্তু সে পরাজয় মেনে নেবে না। দুজন মানুষের কথার মাঝখানে সে বলে বসে, –
‘কী জন্যে এসেছেন? মেয়ের খবর পেয়ে নাকি…?’ ‘তোমাকে নিতে এসেছি আমি, বিকেলের বাসে যেতে চাই।’ ‘আজ এসেই যাওয়ার কথা কেন জামাই? দুটো দিন থাকতে হয় না?’ ‘না বাবা উনি এসেছেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যাবেন।’ ‘এত তাড়াতাড়ি গোছগাছ করতে পারবি?’ ‘আমি যাব না।’ ‘কেন, তুমি যাবে না কেন?’ ‘যাব না…আর কোনো কথা আছে?’ ‘এ তো রাগের কথা হলো মা, সংসারে কত অভিমান কত রাগারাগি হয়; ওসব মনে রাখলে চলে?…জামাই তুমি থাকো। দুদিন না হয় আজকের রাতটা থাকো, কালকে যেও।’ ‘আমি তো তার সঙ্গে যাব না।’
রিনি দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করে দোলনার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘরের ভেতর সূর্যের আলো এসে পড়েছে। তার কেন জানি মনে হতে থাকে, মঈন একজন দূরের মানুষ। তাকে বাইরে থেকে সুপুরুষ আর সুস্থ দেখালেও মন-মানসিকতায় এক প্রতিবন্ধী ছাড়া কিছু নয়। সে কী করে তার সঙ্গে জীবনের বাকি পথ পাড়ি দেবে? সে পারবে না। কিছুতেই না। তার দুচোখে আকস্মিক এক বিষাদ জমা হতে থাকে।
তখন বারান্দায় কথামালার এক গুঞ্জন বাতাসে ঢেউ তুলে ভেসে ভেসে মনের গহিনে ছড়িয়ে যেতে চায়।