বড়লেখা :: যে বাড়িটিতে দুদিন আগেও মানুষ ছিলো। মানুষের আনাগোনা ছিলো। সেই বাড়িতে এখন মানুষ নেই। মানুষের আনাগোনাও নেই। ঘাতকের নির্মম নৃসংশতায় বাড়িটি এখন নীরব-নিস্তব্ধ।
এমন দৃশ্য এখন মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের পাল্লাথল চা বাগানের নিহত লক্ষ্মী বুনার্জির বাড়ির।
গত রোববার ভোর রাতে নিজবাড়িতেই মেয়ে জলি বুনার্জির স্বামী ঘাতক নির্মল কর্মকারের হাতে মেয়েসহ প্রাণ হারাণ লক্ষ্মী বুনার্জি। স্ত্রী ও শ্বাশুড়িকে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি ঘাতক নির্মল। তাদের বাঁচাতে এসে প্রাণ দিতে হয়েছে প্রতিবেশি বসন্ত ভৌমিক এবং বসন্তের মেয়ে শিউলী ভৌমিককে। এসময় আহত হয়েছেন বসন্তের স্ত্রী কানন ভৌমিক। ভাগ্য ভালো থাকায় পালিয়ে বেঁচে গেছে জলির নয়বছরের শিশুকন্যা চন্দনা বুনার্জি। একে একে সবাইকে হত্যার পর নিজেকেও শেষ করে দেয় নির্মল। প্রথমে নিজেই নিজের মাথায় দা দিয়ে কোপ দেয়। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সে।
সোমবার বিকেলে সরেজমিনে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ঘটনার পর থেকে বাড়িটিতে কেউ নেই। লক্ষ্মী বুনার্জির ঘরের পাশেই প্রতিবেশি বসন্ত ভৌমিকের ঘর। ঘরগুলোর দরজা-জানালা বন্ধ। বাড়িটি এখন একেবারে নীরব-নিস্তব্ধ। বাড়ির উঠানে এখনও রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। যেই বাড়িতে দুদিন আগে প্রতিবেশিদের আনাগোনা ছিল। সেই বাড়িটিতে প্রয়োজনে পুলিশ ছাড়া কেউই যাচ্ছেন না। ঘাতক নির্মলের দায়ের কোপ থেকে বেঁচে যাওয়া জলির মেয়ে চন্দনাও এখন অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আর ওই বাড়ির বসন্ত ভৌমিকের স্ত্রীও এখন হাসপাতালে। বাগানে নেই কোনো কর্মচাঞ্চল্য। প্রতিদিনের মত কেউ আর যার যার কাজ যায়নি। চায়ের ফ্যাক্টরিও বন্ধ। এই ঘটনায় হতবাক স্থানীয় চা শ্রমিকরা। কারণ অতীতে কোনোদিন তারা এমন নৃসংশতা দেখেনি।
এসময় কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা বলেন, প্রথমে ঘটনাটি শুনে আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ এরকম ঘটনা আমাদের জীবনে কোনোদিন দেখিনি। আমরা সবাই মিলেমিশে এখানে দীর্ঘদিন ধরে বাস করছি। আমরা প্রায় তাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতাম। ঘটনার পর থেকে আর যাইনি। ভয় লাগছে। এ ঘটনায় সত্যিই আমরা খুবই মর্মাহত। তারা জানান, নির্মল ঘর জামাই ছিলেন। তিনি বাগানে মাঝে মধ্যে কাজ করতেন। আর নিহত বাকি সবাই বাগানের শ্রমিক ছিলেন।
পাল্লাথল চা-বাগানের হ্যাড ফ্যাক্টরি ক্লার্ক অঞ্জন দাস বলেন, এই ঘটনায় পুরো বাগানবাসী স্তব্ধ। এটি একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা। বেশি খারাপ লাগছে জলিকে বাঁচাতে গিয়ে দুজন প্রতিবেশি নির্মমভাবে খুন হয়েছেন।
উত্তর শাহবাজপুর ইউপির চেয়ারম্যান আহমদ জুবায়ের লিটন বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। একসাথে এত মানুষ খুন হয়েছে। এতে পুরো বাগানবাসী স্তব্ধ। বাকরুদ্ধ। কারণ এরকম ঘটনা অতীতে কোনোদিন ঘটেনি। তিনি জানান, বেঁচে যাওয়া নিহত জলি বুনার্জির মেয়ে চন্দনা বুনার্জির লেখাপড়াসহ যাবতীয় সব কিছুর দায়িত্ব তিনি নেবেন।
এদিকে সোমবার বিকেলে পাঁচজনের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে বাগান পঞ্চায়েত কমিটির কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। এরপর বাগানের ৮ নম্বর শ্মশান ঘাটে তাদের সৎকার সম্পন্ন হয়। এর আগে উপজেলার পাল্লাথল চা বাগানের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান। এ সময় মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমদ, সিলেটের সহকারী পুলিশ সুপার গৌতম দেব, উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আহমদ জুবায়ের লিটন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, একই সাথে পাঁচজন মানুষের মৃত্যু, খুবই মর্মান্তিক একটি ঘটনা। এবিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নিহত জলি বুনার্জির মেয়ে চন্দনা বুনার্জির ব্যাপারে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে সে যাতে শিক্ষিত ও ভালো মানুষ হিসেবে সমাজে বেড়ে উঠতে পারে এজন্য আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করা হবে।