আন্তর্জাতিক ডেক্স:: ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়া সহিংস বিক্ষোভের জন্য পরোক্ষভাবে শুধু মুসলমানদের দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
ঝাড়খন্ডে এক নির্বাচনী সভায় মি. মোদী বলেন, “এই সব আগুন কারা লাগাচ্ছে, সেটা তাদের পোশাক দেখলেই চেনা যায়।”
ওই নির্বাচনী জনসভায় রবিবার তিনি বলেন, “আমার ভাই ও বোনেরা, এই যে দেশে আগুন লাগানো হচ্ছে, টেলিভিশনে যে সব ছবি আসছে সেগুলো কি আপনারা দেখেছেন?”
“আগুন কারা লাগাচ্ছে, সেটা কিন্তু তাদের পোশাক দেখলেই চিনতে পারা যায়!”
আর এর পেছনে কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলগুলি উসকানি দিচ্ছে বলেও প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন।
বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে সরাসরি একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের প্রতি সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হিসেবেই চিহ্নিত করছেন।
প্রসঙ্গত, গত কয়েকদিনে ভারতের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন অনেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে লুঙ্গি এবং টুপি পরিহিত লোকজন লাঠিসোঁটা বা পাথর নিয়ে বিভিন্ন রেল স্টেশনে ভাঙচুর চালাচ্ছে।
কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ট্রেন থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে ওই ক্ষুব্ধ জনতা ট্রেনগুলোতে হামলা চালাচ্ছে। এই সব ভিডিও অনেক মূল ধারার গণমাধ্যমেও প্রচার করা হয়েছে।
এই সব ভিডিও আদৌ সত্যিকারের, না কি বানানো তা বিবিসি যাচাই করতে পারেনি – তবে এগুলো নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্ক কিন্তু থেমে নেই।
প্রধানমন্ত্রী মোদী তার ভাষণে এই সব ভিডিওর কথাই উল্লেখ করেছেন।
অনেকেই যেমন এই সব ভিডিও শেয়ার করে লিখছেন, “এদের আদৌ ভারতের নাগরিক থাকার অধিকার আছে কি না সেটা বিচার করে দেখুন!”
দিল্লিতে বিরোধী নেতাদের এক যৌথ প্ল্যাটফর্ম থেকে কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ সোমবার দাবি করেন, শুধু একটি বিশেষ ধর্মের মানুষই নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে বিষয়টি মোটেও তেমন নয়।
তিনি বলেন, “হিন্দু-মুসলিম-শিখ-খ্রিষ্টান সবাই মিলেই এই আইনের প্রতিবাদ জানাচ্ছে কারণ এটা আনা হয়েছে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। বিজেপি এই প্রতিবাদকে সাম্প্রদায়িক চেহারা দিতে চাইছে।”
কংগ্রেস-সিপিআইএম-সমাজবাদী পার্টি-আরজেডির মতো অনেক বিরোধী দল একযোগে ওই মঞ্চ থেকে ঘোষণা করে তারা আদৌ কোনও সহিংস প্রতিবাদে উসকানি দিচ্ছে না – বরং মানুষ আইনটির বিরুদ্ধে স্বত:স্ফূর্ত প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
আর কলকাতার রেড রোডে এক বিশাল সমাবেশ থেকে জনতাকে শপথ বাক্য পাঠ করান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি – যে রাজ্যবাসী সবাই ভারতের নাগরিক থাকবেন – এবং পশ্চিমবঙ্গে তারা এনআরসি ও নাগরিকত্ব আইন জারি করতে দেবেন না!
ভারতের নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে কেন্দ্র করে রবিরার রাতে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ও আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে যে পুলিশি নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস।
মুম্বাই থেকে হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতা – সর্বত্র এই আইনের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন দেশের ছাত্রছাত্রীরা।
পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় রাজ্য সরকার এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিশাল পদযাত্রা ও সমাবেশও করেছে।
বস্তুত বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এখন আর শুধু উত্তর-পূর্ব ভারতেই সীমাবদ্ধ নেই, গত চব্বিশ ঘণ্টায় মুম্বাই বা চেন্নাইয়ের আইআইটি থেকে শুরু করে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি বা হায়দ্রাবাদের মৌলানা আজাদ উর্দু ইউনিভার্সিটিতেও আছড়ে পড়েছে বিক্ষোভের ঢেউ।
আর এর সূচনা হয় তখনই, যখন রবিবার বিকেলে দিল্লিতে দেশের অন্যতম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় জামিয়া মিলিয়ার লাইব্রেরি ও ছাত্রাবাসে ঢুকে দিল্লি পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে, রাস্তায় ছোঁড়া হয় কাঁদানে গ্যাসের শেল।
সরকারি বাসে আগুন ধরানো হয়, ভীত সন্ত্রস্ত ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ করেন পুলিশ জামিয়া ক্যাম্পাসের মসজিদকেও নাকি রেহাই দেয়নি।
জামিয়ার একজন ছাত্রী বলছিলেন, “আমি আইন বিভাগের শিক্ষার্থী – এদিন আমার সংবিধানের পরীক্ষা ছিল। কিন্তু সংবিধান পরোয়া করে প্রশাসন?”
“পুলিশ মেয়েদের হস্টেলেও ঢুকে পড়েছে, প্রাণভয়ে ছাত্রছাত্রীরা পালাতে বাধ্য হয়েছে।
শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ যে রাস্তা নিয়েছিল তাতে সবাই চরম আতঙ্কিত – এবং তাই হস্টেল খালি করে সবাই এখন বাড়ির পথে, জানাচ্ছিলেন আরেক ছাত্রী শামিয়াও।
জামিয়া মিলিয়ার উপাচার্য নাজমা আখতারও স্বীকার করেছেন, “পুলিশ লাইব্রেরির ভেতরে ছাত্রছাত্রী ও বহিরাগত – সবাইকেই নির্বিচারে মারধর করেছে এবং তারা ক্যাম্পাসে ঢোকার আগে কোনও অনুমতিও নেয়নি।”
একই ধরনের পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকেও – আর এরপরই জামিয়া ও আলিগড়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সংহতি জানাতে পথে নামে ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস কিংবা কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসে ছাত্রদের প্রতিবাদে সামিল হয়ে অধ্যাপিকা অঞ্জলি মান্টেরোও বলছিলেন, “জামিয়া বা আলিগড়ে যা ঘটছে তা মৌলিক মানবাধিকারের বিরোধী বলেই আমরা প্রতিবাদে বাধ্য হচ্ছি।”