বিজ্ঞানচর্চা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এই চর্চায় গবেষককে ধৈর্য্যধরে দীর্ঘদিন গবেষণা করে যেতে হয়। এই দীর্ঘ সফরে ছোট ছোট নানা অর্জন ঘটে এবং এই অর্জন গুলো সমন্বয়ে এক সময় বড় অর্জন ঘটে। বিজ্ঞান সম্পর্কে অন্তত প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন না করলে এ যুগের শিক্ষাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বিভিন্ন বিজ্ঞান মেলার আয়োজন এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।শিক্ষার শেকড় হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলতে প্রাথমিক স্তর থেকেই তার আগ্রহ তৈরির কাজ শুরু হয়। তাই এই স্তর থেকেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।
বিদ্যালয়ভিত্তিক বিজ্ঞান মেলার প্রয়োজনীয়তাঃ
ধারাবাহিক বিশ্লেষণপন্থী ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা হচ্ছে বিজ্ঞান শিক্ষা। বিদ্যালয়ভিত্তিক বিজ্ঞান মেলা প্রতিটি শিশুর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। হাতে-কলমে আনন্দ সহকারে পাঠ্যবইয়ের প্রজেক্ট গুলো নিজহাতে তৈরি করে ফলে তারা বিজ্ঞানের মজার দিকগুলো অনুধাবনে সক্ষম হয়। তাছাড়া মেলায় অন্যের তৈরিকৃত প্রজেক্টগুলো তারা আনন্দ নিয়ে দেখে জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করে।শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনার উৎকর্ষ সাধন করতে বিজ্ঞান মেলার গুরুত্বঅপরিসীম।
প্রক্রিয়াঃ
৩য়-৫ম শ্রেণির প্রাথমিক বিজ্ঞান বইয়ের সমস্ত প্রজেক্টগুলো চিহ্নিত করে বিজ্ঞান শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে এ সম্পর্কে আলোচনা করবেন। প্রতিটি শ্রেণিতে সবল ও দুর্বল শিক্ষার্থীর সমন্বয় করে ৪/৫ জন করে কয়েকটি দলে ভাগ করতে হবে।কর্মতৎপরতা ও বুদ্ধিমত্তা বিবেচনায় রেখে দলনেতা নির্বাচন করতে হবে।আলোচনা সাপেক্ষে বিজ্ঞান শিক্ষক দলগুলোতে প্রজেক্টগুলো ভাগ করে দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিবেন।(প্রধান শিক্ষক সকল কার্যক্রম মনিটর করবেন এবং প্রতি শ্রেণির বিজ্ঞান শিক্ষকের সাথে অন্যান্য শিক্ষকদের দলে ভাগ করে দিবেন যাতে সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।)নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে প্রজেক্ট তৈরি করবে।নির্দিষ্ট প্রজেক্টের উপস্থাপনে শিক্ষক তাদের উৎসাহ দিবেন ও সে সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য জানতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবেন। এ সম্পর্কে যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে নিজেকে প্রস্তুত রাখতে সকল শিক্ষার্থী নিজ নিজ প্রজেক্ট সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান আহোরণ করবে। প্রজেক্ট তৈরিতে ও উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে সকল শিশুর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।নির্দিষ্ট দিনে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিভিত্তিক স্টলগুলোতে তাদের প্রজেক্টগুলো রাখবে এবং শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে নিজ নিজ স্টল সাজাবে।স্টল সাজানোর পর প্রতি দল থেকে একজন শিক্ষার্থী স্টলে অবস্থান করবে ও স্টলের সামনে দর্শনার্থী আসামাত্র প্রজেক্ট উপস্থাপনে সচেষ্ট থাকবে। স্টলে অবস্থানরত শিক্ষার্থী এ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সুন্দরভাবে উপস্থাপন করবে এবং আগ্রহী দর্শনার্থীদের সব ধরনের প্রশ্নের জবাব দিবে। একঘন্টা পর পর দায়িত্ব বদল হবে(দলের অন্য শিক্ষার্থী স্টলের দায়িত্ব নেবে)।এভাবে প্রতিটি শিক্ষার্থী উপস্থাপনের সুযোগ পাবে।শিক্ষকরা সকল কার্যক্রম তদারকি করবেন।
বাস্তব অভিজ্ঞতাঃ
বিগত কয়েক বছর ধরে কদমতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েবিজ্ঞান মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।পুরো ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে এ নিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থী সকলের মধ্যে কর্মব্যস্ততা দেখা যায়। কারা কী প্রস্তুত করবে ,কীভাবে করবে তাই নিয়ে প্রাথমিক বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তক ঘাটাঘাটির পাশাপাশি চলে আলোচনা।এমনকি বাড়িতে গিয়েও শিশুরা অভিনব কোন কিছু তৈরির প্রচেষ্টা চালায়।এই মাসে শিশুরা শুধুমাত্র বিদ্যালয় নয় বাড়িতে গিয়েও বড় ভাইবোনদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে বিজ্ঞানের সংস্পর্শে। মেলায় পাঠ্যবইয়ের প্রজেক্ট ছাড়াও শিক্ষার্থীদের তৈরি নানা রকমের যন্ত্র ও প্রজেক্ট উপস্থাপিত হয়। বিদ্যালয়ে উল্লেখিত প্রক্রিয়া অবলম্বন করে বিজ্ঞান মেলা পরিচালনা করা হয়।এতে দুর্বল-সবল সকল শিশু সক্রিয় থাকে।“আমিও পারি”- এমন একটা ভাব সকল শিশুর চোখে মুখে ফোটে উঠে। বছরের শুরুতে পুরোটা বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ের সাথে তাদের পরিচয় হয়ে যায়।
নির্দিষ্ট দিনের জন্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয় মাঠে শ্রেণিভিত্তিক স্টল তৈরি করে।‘বিজ্ঞান মেলা’ উপলক্ষে সকাল ৭টা থেকেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাজসাজ রব পড়ে যায়। শিক্ষার্থীরা দলীয়ভাবে তাদের তৈরি ও আবিষ্কৃত বিভিন্ন প্রজেক্ট দিয়ে প্রদর্শনীর জন্য নির্ধারিত স্টলটিকেসাজিয়ে বিজ্ঞানময় জগৎ তৈরি করে।বিজ্ঞান মেলায় আগত প্রধান অতিথিকে ফুলের তোড়া ও বিদ্যালয়ের মনোগ্রামসংবলিত ব্যাজ দিয়ে সাদরে বরণ করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বিজ্ঞান মেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। প্রধান অতিথি ও প্রধান শিক্ষক মহোদয় শিক্ষার্থীদের স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন। শিক্ষার্থীদের প্রজেক্টগুলো মোট তিনটি স্টলে বিভক্ত থাকে। দায়িত্বরত শিক্ষার্থীরা স্বতঃফুর্তভাবে তাদের কাজ উপস্থাপন করে। প্রধান অতিথি প্রতিটি প্রজেক্টই মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করেন।মেলায় প্রধান অতিথি ছাড়াও কয়েকজন বিশেষ অতিথিকে আমন্ত্রণ করা হয়। মেলা চলাকালীন সময়ে সকলে মেলা পরিদর্শন করেন। এই মেলায় শিক্ষার্থী,অভিভাবক ও এলাকার মানুষের উপস্থিতি নজরকাড়ার মতো।এ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান মেলা উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।পুরোটা দিন বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক দলটি মঞ্চ মাতিয়ে রাখে নাচে-গানে।স্টলে বসে থেকেও মঞ্চের অনুষ্ঠান দেখার ব্যবস্থা থাকায় কেউই ক্লান্তিবোধ করে না।আগত অতিথিবৃন্দ ও দর্শনার্থীবৃন্দ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন।বিকাল ৪ ঘটিকা পর্যন্ত প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দিনটি চলে যায়।মেলা উপলক্ষ্যে ঐ দিন বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ থাকে।মেলা শেষে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সবচেয়ে কর্মতৎপর শিশু নির্বাচন করা হয় এবং শ্রেণিকক্ষে রাখার মতো কোনো পুরষ্কার দিয়ে তিনটি স্টলের শিক্ষার্থীদের পুরষ্কৃত করা হয়।
উপকারিতাঃ
বিজ্ঞান মেলায় শিক্ষার্থীরা খেলার ছলে পাঠ্যবই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করে।হাতে কলমে কাজ করে মুখস্ত না করেই অনেক কিছু শিখে নেয়। দলগত কাজ করার দক্ষতা জন্মায়।বিজ্ঞান ভীতি দূর করে তাদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলে। উপস্থাপনের জড়তা কাটিয়ে সাবলীল ও আত্মবিশ্বাসী হয়।সকল শিশু সমানভাবে কাজের সুযোগ পায় এবং একে অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিতে শেখে।
সীমাবদ্ধতাঃ
বিদ্যালয়ের নিয়মিত পাঠদানের মধ্যে বিজ্ঞান মেলার প্রস্তুতি নেয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার।প্রয়োজনীয় ফান্ডের অভাবে অনেক প্রজেক্ট দায়সাড়াভাবে করা হয়।
মন্তব্যঃ
দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিজ্ঞান শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে “বিজ্ঞান সপ্তাহ” চালুর মাধ্যমে বিজ্ঞান মেলা বাধ্যতামূলক করলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানমনস্ক হবে। বিজ্ঞান সপ্তাহে অন্য বিষয়ের পাঠদান বন্ধ থাকলে বিজ্ঞান মেলার আয়োজন সুন্দরভাবে করা যাবে।“বিজ্ঞান মেলা কিভাবে হবে”- তার একটি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা বিদ্যালয় শিক্ষকদের মেলাটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে সহায়তা করবে। মেলার কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য কিছু সরকারি বরাদ্ধ ও প্রয়োজন।প্রতি বিদ্যালয়ে নুন্যতম ১ জন বিজ্ঞান শিক্ষক থাকা আবশ্যিক।
সম্পাদনায়ঃ
মোসা মুনিরা বেগম চৌধুরী
প্রধান শিক্ষক
কদমতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়