নানা বিতর্কের পর এবার পদবঞ্চিত হলেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। গত ৮ বছর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে তিনি এবার পদবঞ্চিত হলেন। শুরু থেকেই তিনি নানা ভাবে আবেগ আর বিনয় প্রকাশ করে নেত্রীর শুভদৃষ্টি কামনা করলেও নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে তিনি সভাপতি পদ থেকে বাদ পড়তে পারেন- এমন গুঞ্জন ছিলো সিলেটের রাজনীতিতে। তবুও শেষ আশায় ছিলেন কামরান। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি।
কামরানের প্রথম পরাজয়টা শুরু হয়েছিলো হয়েছিলো ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত সিসিক নির্বাচনের মধ্যদিয়ে। টানা দুই বারের মেয়র হলেও সেময় নানা কারণে নগরবাসীর আস্তা হারালে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন তিনি। এরপর থেকেই তাঁর ভাগ্যে কেবল ব্যর্থতা। সফলতার মুখ আর দেখেননি। বরং নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়ে সর্বশেষ ২০১৮ সালেরে জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সিসিক নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষের প্রার্থী বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে ফের পরাজিত হন তিনি। কিন্তু নির্বাচনের পর পর তাঁর অনুসারী কর্মী সমর্থকদের পক্ষ থেকে চলে সিলেট আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ। ‘পরিকল্পিত ভাবে পরাজিত করা হয়েছে’- এমনটিও ছিলো তাদের অভিযোগ। ‘কিন্তু নানা সমালোচনায় জনগণ আস্থা হারিয়েছেন’ এমনটি ছিলো দলীয় নেতাকর্মীদের ইঙ্গিত। অবশ্য নির্বাচনের আগেও তিনি অনেকটা টানাপোড়েনে পরেছিলেন তারই কমিটির সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ’র কারণে। সে সময় আসাদ উদ্দিন আহমদ সিসিক নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে শক্ত অবস্থান নিলে পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে মনোনয়ন পান কামরান। মনোনয়ন পাওয়ার পর নিজের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানিয়েছিলেন এটাই তাঁর জীবনের শেষ নির্বাচন। কিন্তু পরবর্তীতে সিটি নির্বাচনে পরাজিত হলে জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে তোড়জোড় শুরু করেছিলেন। শেষে সে ভাগ্য তাঁর আর হয়নি। দীর্ঘদিন থেকে কামরানের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা আর বিতর্কের গুঞ্জন থাকলেও সেটা ছিল অনেকটা আড়ালে। কিন্তু গুঞ্জন প্রকাশ্যে আসে ২০১৮ সালের ২৭ মে নগরীর বন্দরবাজার এলাকায় মাদক উদ্ধারে গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের হামলায় ২ পুলিশ সদ্য আহতের ঘটনার মধ্যদিয়ে। সে সময় পুলিশ সদস্য দুইজন আহত হলেও পরে বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের মধ্যস্থতায় ১০ লাখ টাকার বিনিময় রফাদফার অভিযোগ উঠে। ঘটনাটি বেরিয়ে আসে একটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে। সে খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেই শুরু হয় সমালোচনা। যার প্রভাব পড়ে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হলেও ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিতর্কের মুখে পরাজিত হন তিনি। ঘটনা এখানেই শেষ না, জামায়াতে ইসলামির সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ব্যাপারেও তাঁর বিরুদ্ধে আছে জনশ্রুতি। নিজে দীর্ঘদিন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে থেকে সিলেট আওয়ামী লীগকে পারিবারকেন্দ্রিক সম্প্রীতিতে পরিণত করার অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় জেলায়ও আছে তাঁর শক্ত অবস্থান। সে অবস্থানকে কাজে লাগিয়েই নিজের ছেলে ডা. আরমান আহমদ শিপলু’র জন্য ভাগিয়ে নিয়েছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক পদটি। কিন্তু অনেক জ্যেষ্ঠ নেতারা এ কমিটিতে সদস্য থাকলেও বদর উদ্দিন কামরানের ছেলে শিপলু’র এ পদ নিয়েও ছিলো নেতাকর্মীদের ক্ষোভ। অপরদিকে সিলেট মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদটিও দখল করে আছেন প্রভাবশালী এ নেতার সহধর্মীনি আসমা কামরান। সব মিলিয়ে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের গণ্ডি পেরিয়ে জেলাও ছিলো তাঁর বেশ প্রভাব। সামনে নেতাবন্ধনায় কর্মীরা মুখোর থাকলেও পেছনে সমালোচনা আর ক্ষোভ কম ছিলো না। তবুও তিনিই ছিলেন ‘নেতা’।
এখানেও শেষ না, সর্বশেষ গত ২৭ নভেম্বর রাত ১ টায় বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের ব্যানার লাগাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঝলসে যায় ১৫ বছর বয়সী তৌফিক নামের এক কিশোর। পরে তার বাম হাতের কনুই পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়। বাম পায়েও আছে গুরুতর জখম। কিন্তু নগর আওয়ামী লীগের সাবেক এ সভাপতি কিশোরকে মাত্র ১ দিন গিয়ে দেখে আসেন সিলেটের ওসমানী হাসপাতালে। সে সময় তাকে ২ হাজার টাকা দিয়ে দায় সারেন তিনি। পরে ওই কিশোরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয় সিলেট ভয়েসে। তাঁর এমন দায়সারা ভূমিকা নিয়েও হয় সমালোচনা। এর আগে যখন ২৭ নভেম্বর রাতে দুর্ঘটনাটি ঘটে তখনই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সব মিলিয়ে বিতর্কের ভার মাথায় নিয়েই যেন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন সম্মেলন মঞ্চে। তাইতো তাঁর এসব কর্মকাণ্ডের বিতর্কের কিছু চিত্রেরও ইঙ্গিত মিলে দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে। তিনি অনেকটা ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘এখন আওয়ামী লীগে নেতা বেড়ে গেছে। কিন্তু কর্মী কমছে। তাই ব্যানার লাগানোর জন্যও কর্মী নেই। ব্যানার লাগাতে হয় টোকাই দিয়ে। কিন্তু ব্যানার আর ছবি লাগিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা হওয়া যায় না।’ অবশ্য কামরান এটাকে ব্যর্থতা বা পদবঞ্চিত হিসেবে বিবেচনা করছেন না। তিনি এটাকে পরিবর্তন হিসেবেই দেখছেন। তিনি সিলেট ভয়েসকে বলেন ‘ আমি দীর্ঘদিন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম। এবার নেত্রী মনে করেছেন নতুনত্ব, তাই নতুনত্ব এনেছেন। এটা আমার পদবঞ্চিত বা ব্যর্থ মনে হচ্ছে না। কারণ আমাকে নেত্রী কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে রেখেছেন।’
নতুন কমিটির ব্যাপারে তাঁর অভিমত জানতে চাইলে বলেন, ‘ আওয়ামী লীগের রাজনীতি দিয়েই আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরু, আমার জীবনের শেষটাও হবে আওয়ামী লীগের আদর্শের সাথে থেকে, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হয়ে। তাই নতুন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আমাকে ডাকলে আমি তাদের যে কোন কাজে সহযোগিতা করবো। সেটা মহানগর হোক আর জেলাই হোক।’ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং পারিবারকেন্দ্রিক সম্প্রীতির বিষয়ে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, ‘আমি মনে করছি না এরকম কিছু আছে।’