পর্দা নামলো সিলেটে চার দিনব্যাপী রবীন্দ্রনাথ স্মরণোৎসবের। গতকাল শুক্রবার উৎসবের সমাপনী দিনে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে কয়েক হাজার রবীন্দ্রপ্রেমীর সমাগম ঘটেছিলো। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তারা রবীন্দ্রনাথকে নানাভাবে উপভোগ করেন। সমাপনী দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী সমাপনী বক্তব্য রাখবেন বলে আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। তবে বিশেষ কারণে ভিডিও কনফারেন্সেও যুক্ত হতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ব্যস্ততার কারণে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত না হলেও সিলেটবাসীর এমন বর্ণিল আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সমর্থন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন’।
ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, শতবছর আগে সিলেটের সকল সম্প্রদায়ের লোক রবীন্দ্রনাথকে বরণ করেছিলেন। তাঁকে বন্দে মাতরম ও আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে সিলেটে স্বাগত জানানো হয়। সে সময়ও সিলেটের সম্প্রীতি ছিলো অনন্য। আজ শত বছর পরও যখন সিলেটের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ কবি রবীন্দ্রনাথের সিলেট আগমনের শতবর্ষ স্মরণ করছে তখন আমার বুক গর্বে ভরে যায়।
সমাপনী দিনে সন্ধ্যার পর আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন স্মরণোৎসব উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সদস্যসচিব হিসেবে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ইনাম আহমদ চৌধুরী, ভারতের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সাবেক ডিন উষা রঞ্জন ভট্টাচার্য, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী। অনুষ্ঠান যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন প্রফেসর শামীমা চৌধুরী ও বাচিক শিল্পী নন্দিতা দত্ত।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিলেটবাসীর অতীত সম্প্রীতির উদাহরণ টানতে গিয়ে অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘শত বছর আগে যখন রবীন্দ্রনাথ সিলেটে আসেন তখন ক্বিন ব্রিজ ছিলো না। তাই চাঁদনিঘাটে এসে যখন বহর থামলো তখন উনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তৎকালীন সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান।
মন্ত্রী বলেন, বিশ্বের মানুষ যখন মারামারি, হানাহানি, হিংসা বিদ্বেষে লিপ্ত, সিলেটের মানুষ তখন সকল ভেদাভেদ ভুলে সম্প্রীতির সংস্কৃতিতে ঐক্যবদ্ধ। যা সিলেটি হিসেবে আমার অনেক আনন্দের এবং গৌরবের। তাই, আমি বলবো সমাজ থেকে সকল সমস্যা, অশান্তি দূর করতে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করতে সকলকে এক সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে।’
ড. এ কে আব্দুল মোমেন আরো বলেন, আজ থেকে ৩ বছর নয় মাস আগে এই সিলেটে বেঙ্গল সাংস্কৃতিক উৎসবে প্রায় ৬০ হাজার সংস্কৃতিপ্রেমী অনুষ্ঠান উপভোগ করেছিলো। তা থেকে বুঝা যায় সিলেটীরা কতটা সংস্কৃতিপ্রেমী। সিলেটের সকল মানুষের সহযোগিতায় আগামীতে সিলেটে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ পালন করা হবে- জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি আগামীতে আপনাদের সকলের সহযোগিতায় সিলেটের মাটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ পালন করা হবে, স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করা হবে।’
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। তিনি সিলেটে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ‘আমি শুনেছি এই উৎসবের একটি অনুষ্ঠানে মেয়র সাহেব সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তাই, আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি যদি প্রস্তাবনা আমার মন্ত্রণালয়ে যায় তাহলে দু’এক মাসের মধ্যে এর উদ্যোগ গ্রহণ করে সিলেটে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। পরিকল্পনামন্ত্রী এই বৃহত্তর সিলেটেরই সন্তান। তাঁর সুদৃষ্টি পেলে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় খুব একটা বেগ পোহাতে হবে না।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ইনাম আহমদ চৌধুরী বলেন, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন ৮০ বছর। এই জীবনে তিনি পরিবেশের যাঁতাকলে পিষ্ট দেশগুলো দেখেছেন। তিনি প্রথম বিশ্ব মহাযুদ্ধ দেখেছেন, শুনেছেন ২য় মহাযুদ্ধের দামামা। তিনি ইংরেজদের আস্ফালন দেখেছেন। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সমাজ সচেতন ছিলেন। পরিবর্তনশীল বিশ্বে, সমস্ত পরিবর্তন তার লেখনীতে স্থান পেয়েছে। ইনাম চৌধুরী বলেন, বিশ্বব্যাপী আজ ধর্মভিত্তিক আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। যা পৃথিবীতে একটি টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে।
ভারতের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সাবেক ডিন উষা রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, করিমগঞ্জ’র রেলস্টেশনে কবি গুরুকে যে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিলো, তা বিরল। শিলচরে ট্রেনের মাত্র ৩ মিনিটের বিরতি ২৫ মিনিটে গিয়ে ঠেকেছিলো। কুলাউড়া হয়ে যখন সিলেটের চাঁদনিঘাটে পৌছেন, তখন হিন্দু মুসলমান সকলে ভেদাভেদ ভুলে কবিগুরুকে স্বাগত জানিয়েছিলো। উষা রঞ্জন বলেন, সিলেটের তৎকালীন সময়ের ছোট্ট শিশু সৈয়দ মুজতবা আলীসহ কত মানুষ যে রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হলেন, আবার সেই ভালো লাগাই শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিলো বিচিত্রভাবে। যার জন্য রবীন্দ্রনাথ শ্রীহট্টপ্রেমী ছিলেন।
স্বাগত বক্তব্যে উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব হিসেবে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী একটি সফল আয়োজনে সহযোগিতার জন্য সিলেটবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত মন্ত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সিলেটে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের দাবি উত্থাপন করেন। সভাপতির বক্তব্যে উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সিলেটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ ও অনেক পুরনো। সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সম্মান রক্ষা করেই আমরা এই উৎসবটির সফলভাবে পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছি। মন্ত্রী বলেন, সিলেটের, ভারতের এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের অনেকেই এই উৎসবে অংশ নিয়েছেন। এজন্য আমি তাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। এ সময় সিলেটে রবীন্দ্রনাথ আগমনের শতবর্ষ স্মারকের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
আলোচনার পর গানের আসর বসে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী ভারতের পদ্মশ্রী পূর্ণদাস বাউল। তার পিতার নাম নবনীদাস বাউল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরম সান্নিধ্য পেয়েছেন এই শিল্পী পরিবার। রবীন্দ্রনাথ নিজেও অবনীদাস বাউলের কন্ঠে বিমোহিত হয়েছিলেন। সেই পূর্ণদাস বাউল সিলেটে আসলেন, গাইলেন। গানের আগে স্মৃতি রোমন্থন করলেন বিশ্বকবির। শুধু গান নয়, এই গুণী শিল্পীকে দেখার জন্যেও মনে হয় গতকাল উৎসবের সমাপনী দিন সিলেট জেলা স্টেডিয়াম ছিলো লোকে লোকারণ্য। ১৯৬০ সালে পূর্ণদাস বাউল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিস্কো শহরের এক গানের অনুষ্ঠানে বব ডিলান কর্তৃক নিমন্ত্রিত হন। তার পর তিনি আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্তত ১৫৩টি দেশে গান গেয়ে এশিয়ার জন্য সুনাম কুড়িয়ে আনেন।
পূর্ণদাস বাউলের আগে মঞ্চে আবৃত্তি নিয়ে আসেন আমিনুল ইসলাম লিটন। গানের পরপরই আবৃত্তি করেন মোকাদ্দেস বাবুল ‘কৃষ্ণ কলি আমি তারেই বলি’। এভাবেই চলে কবিতা পড়ার প্রহর। তারপর মঞ্চে আবার বিশ্বকবির গান নিয়ে আসেন ড. অনুপম কুমার পাল, ড. অসীম দত্ত। গানের ফাঁকে আসে নৃত্য। দর্শকরা মুগ্ধ হন নৃত্য রং, মণিপুরী ও নৃত্যশৈলী’র নৃত্য দেখে। পদ্মশ্রী পূর্ণদাস বাউলের পর দর্শকদের দৃষ্টি ছিলো বাংলাদেশের গুণী রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা’র দিকে। যদিও অনুষ্ঠানের প্রায় শেষের দিকে বন্যা মঞ্চে আসেন। তাঁর গান মুগ্ধ করে সিলেটের শ্রোতাদের। বন্যা গেয়ে শোনান বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত। ততক্ষণে দর্শকরাও নড়েচড়ে বসেন। প্রিয় শিল্পীর গানের সঙ্গে সুর মেলালেন তারাও। হাত নেড়ে শিল্পীকে উৎসাহ দিলেন। এভাবে অনেক গুণী শিল্পীর সুরে মোহনীয় হয় সিলেটে চার দিনব্যাপী রবীন্দ্র স্মরণোৎসবের সমাপনী দিন।