বিশেষ প্রতিনিধি: স্ত্রী ও দুই সন্তান হত্যায় ব্রিটেনের দোষী সাব্যস্ত হলেন বাংলাদেশি শেফ আবদুল শুকুর। বৃহস্পতিবার লন্ডনের ওল্ড বেইলি আদালত তিনটি হত্যার দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এখন আবদুল শুকুরকে জীবনের বাকি দিনগুলো কারাগারের ভেতরেই কাটাতে হতে পারে।
১৯৯৯ সালের অক্টোবরে আবদুল শুকুরের সাথে বিয়ে হয় তার লন্ডনপ্রবাসী চাচাতো বোন জুলি বেগমের সাথে। বিয়ের সূত্রেই লন্ড আসেন শুকুর। জুলি-শাকুরের বিয়ের সম্পর্ক সুখের হয়নি। মূল বিরোধ বাঁধে শাকুরের যুক্তরাজ্যে বৈধতা পেতে জুলির সহায়তা না করায়। জুলির ভয় ছিলো যদি তার স্বামী বৈধতার কাগজপত্র পেয়ে যান, তাহলে তাকে তালাক দিয়ে অন্য নারীকে বিয়ে করবেন। সে কারণেই জুলি চাইছিলেন না, তার স্বামীর অভিবাসন আবেদনের অগ্রগতি হোক। জুলির ভয়টি অমূলক ছিলো না। কারণ শাকুর তার শ্যালিকাকে বলেছিলেন, দুই কন্যা সন্তানের জন্মে তিনি খুশি নন। কারণ তিনি ছেলে সন্তান আশা করেছিলেন। এছাড়া জুলিকে বিয়ে করেও নাকি শাকুর তৃপ্ত ছিলেন না। কারণ জুলির গায়ের রঙ কালো। নাগরিকত্ব পেতে স্ত্রীর সহায়তায় না পাওয়ায় শাকুর জুলিকে হুমকি দিয়েছিলেন, জুলি ও তার পরিবারের প্রত্যেককে হত্যা করবেন তিনি। স্ত্রীর হাত ধরে বিলেতের নিরাপদ জীবন উপহার পেলেও স্ত্রী-সন্তানরা আবদুল শাকুরের কাছে নিরাপদ থাকেননি। স্ত্রী ও দুই শিশু কন্যা খুন হন তার হাতে।
২০০৭ সালে বছরের প্রথম দিনই এ নৃশংসতার শিকার হন জুলি বেগম ও তার ছয় বছর বয়সী মেয়ে তানহা খানম ও পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে আনিকা খানম। ২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি জুলির বোন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে পুলিশকে জানান যে, ১ জানুয়ারির পর থেকে তার বোন ও তার দুই বোনঝির খবর পাচ্ছেন না। পুলিশ নেলসন স্ট্রিটের বাসায় গিয়ে দেখে জুলি বেগম ও তার সন্তানদের মরদেহ পড়ে আছে। পুলিশ সিসি টিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখতে পায় ১ তারিখই সর্বশেষ জুলি এবং তার দুই কন্যাকে দেখা গিয়েছিলো শাকুরের সাথে। এর পরদিন লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে যান শাকুর এবং জরুরি ভিত্তিতে একটি পাসপোর্ট নিয়ে ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন। ধারণা করা হচ্ছে পরে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ২০১২ সালে ভারতীয় পুলিশ অভিবাসী আইনে শাকুরকে গ্রেপ্তার করে।
সেখান থেকে ফেরত এনে গত এপ্রিলে তাকে বার্কিংসাইড ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির করা হয়। যুক্তরাজ্য সরকার শাকুরকে ফেরাতে ২০১৩ সালে তৎপর হয়, ৫ বছরের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় তাকে ফেরত পেতে সমর্থ হয় তারা। শাকুরকে ভারতের এক ফ্লাইটে হিথ্রো বিমানবন্দরে এনে আটক করা হয়। লন্ডন মেট্রো পুলিশের এক মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, ২০০৭ সালে স্ত্রী ও দুই কন্যাকে হত্যার ঘটনায় শাকুরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।
একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয় শেফের কাজ করতেন শুকুর। পারিশ্রমিক বাবদ শাকুরের হাতে নগদ অর্থ তুলে দেয়া হতো এবং তিনি তা সিলেটে পাঠাতেন। ওই রেস্তোরাঁর ওপরে কোয়ার্টারে রাত কাটাতেন শাকুর। জুলি তার শিশুদের জন্য যে সোশ্যাল বেনিফিট পেতেন তাই দিয়েই সংসার চালাতেন। এ নিয়ে দুজনের প্রায়ই ঝগড়া হত। এক রাতে এক সহকর্মীর কাছ থেকে ১০০ পাউন্ড ধার নিয়ে পূর্ব লন্ডনের ইস্ট হ্যামে অবস্থিত জুলি বেগমের বাসায় যান শুকুর। এরপর তিনি স্ত্রীর সাথে রাতও কাটান। দুজনে অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর পর শুকুর জুলি বেগমকে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। আর বড় মেয়ে তানহাকে মাথার খুলিতে আঘাত করে এবং ছোট মেয়ে অনিকাকে সাদা মোজা দিয়ে ফাঁস দিয়ে হত্যা করেন। পুলিশ পরে তাদের লাশ উদ্ধার করে। জুলি বেগমের লাশ আনিকার সাথে বেডকভারে ঢাকা ছিলো। আর তানহার লাশ পড়েছিলো তাদের সামনে। ঘর থেকে খোয় গিয়েছিলো বেশ কিছু স্বর্ণালঙ্কার।
এর আগেও জুলি বেগমকে পিটিয়েছিলেন শুকুর। ২০০১ সালে যখন তার জুলি গর্ভবতী ছিলেন। বিয়ের পর জুলি বেগম কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারতেন না। তার জীবন ছিল বন্ধুবিহীন। প্রসিকিউটর ডেভিড স্পেনস নির্মমতার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। হত্যার ঘটনাটি ঘটে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে। তখন তিনি সারে’র একটি রেস্তোরাঁয় দৈনিক ১৩০ পাউন্ডের বিনিময়ে কাজ করতেন। হত্যার পর নিজের পিতা মারা যাওয়ার কথা বলে ৫ই জানুয়ারি বাংলাদেশে চলে আসেন শুকুর।
জুলি বেগমের পরিবার এক বিবৃতিতে বলেছে, আবদুল শুকুর আমাদের পুরো পরিবারকে ধ্বংস করেছে। সে এক মিষ্টি মা ও বোন, জুলিকে কেড়ে নিয়েছে। সে কেড়ে নিয়েছে দুই মিষ্টি মেয়ে তানহা ও অনিকার ভবিষ্যত। আমরা তাদের প্রতিদিন মনে করি। এবং কখনোই এ ক্ষতি পোষানো সম্ভব নয়।
জুলি বেগমের বোন শেলি বেগম বলেন, সে শুধু আমার বোনই ছিলো না, আমার বন্ধুও ছিলো। আমি সবকিছুই তার সাথে শেয়ার। তার দুটো মেয়ে ছিলো আমার মেয়ের মতোই। ছোট মেয়েগুলো খেলতে খুব পছন্দ করত আর সব সময় পোশাক পাল্টাতো।