গতিশীল এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সম্মুখপানে। আর প্রযুক্তি নির্ভর বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় সেই গতি দূনির্বার। ঘূর্ণায়মান এই জীবন ব্যবস্থায় প্রতি মুহুর্তে পৃথিবীতে জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য মানবশিশু এবং নিঃশব্দে পৃথিবী থেকে পরপারে পাড়ি দিচ্ছে আরো অসংখ্য মানুষ। আর তাই আমাদের অতি আপনজনও আমাদের মধ্য হতে চলে গেলেও নতুন নতুন মুখের কলরবে এবং নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মানের লক্ষ্যে অতীতকে ভুলে বর্তমান কর্মসাগরে ডুবদিয়ে সেই সব হারিয়ে যাওয়া মুখের সুন্দর সুন্দর স্মৃতিগুলোও সময়ের ব্যবধানে বিস্মৃত হয়ে যায়। এমনই নিষ্টুর জীবন ব্যবস্থায় চাকুরী জীবনে আমাদের জীবন শ্রোতের সাথে একাকার হয়ে ২০১১ সালের ০৯ ফেব্রুয়ারী হতে সাড়ে ৬টি বছর কাটিয়ে নীরবে যিনি চলে গেলেন এবং রেখে গেলেন অসংখ্য স্মৃতি তেমন একজন মানুষ হচ্ছেন মরহুম আলহাজ্ব মোঃ হারুণূর রশিদ । তিনি আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিঃ এর একজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কুমিল্লা জোনের জোনাল হেড হিসাবে কর্মরত থাকা অবস্থায় বিগত ১৪ জুলাই ২০১৭ ইং রোজ শুক্রবার বাদ জুম’য়া ৩.১৫ মিঃ এর সময় তাঁর স্ত্রী, এক প্রুত্র, দুই কন্যা, মা-বাবা সহ অসংখ্য গুনগ্রাহীকে শুকের সাগরে ভাসিয়ে নিজে আল্লাহু অল্লাহু বলতে বলতে এই ইহলোক ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহী ওয়া ইন্না ইলাহী রাজীউন)। আজ তাঁহার দ্বিতীয় ইন্তেকাল বার্ষিকী ।
কলি থেকে ফুল ফুটবে, ফুল তার সৌরভ সমাজে ছড়িয়ে দেবে এবং এক পর্যায়ে সে তার জীবন সহায়ন্বে পৌঁছবে এবং এক পর্যায়ে বৃন্ত থেকে ঝড়ে পড়বে এটাই প্রকৃতির অমোগ নিয়ম। কিন্তু যদি কোন ফুল তার সৌরভ পূর্ণ মাত্রায় ছড়ানোর আগেই ঝড়ে যায়, তা যেমন কাঙ্খিত নয় তেমনই কোন সফল জীবনের হঠাৎ সমাপ্তি তার শুধু আপন জনকেই নয় আশপাশের পরিবেশকেও কাঁদায়, বেদনাবিদূর করে তোলে। মোঃ হারুণূর রশিদের হঠাৎ নীরবে পরপারে পাড়ি দেওয়া একই ভাবে আমাদেরকে ব্যথিত করে তোলে। আজকের এই লিখনি তাহাকেই কেন্দ্র করে।
১৯৭০ সালের ১ম এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্থাগঞ্জ থানার ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়নের সুচিউড়া গ্রামে (বর্তমানে হবিগঞ্জ ই-াষ্ট্রিয়েল পার্কা সংল্গন এলাকা) এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ৪ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। গ্রামের স্কুল হতে পাঠশালার পাঠ শেষ করে মৌলভীবাজার সরকারী স্কুল হতে ১৯৮৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি এবং ১৯৮৭ সালে মৌলভীবাজার সরকারী কলেজে হতে বাণিজ্যিক বিষয়ে এইচএসসি’তে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স বিষয়ে ¯œাতক সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৯০ সালে ¯œাতক সম্মান ও ১৯৯১ সালে (পরীক্ষা ১৯৯৩ সালে অনুষ্টিত হয়) একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সহিত ¯œাতকোত্তর সম্পন্ন করে ১৯৯৪ সালে কর্মজীবনে পদার্পন করেন। কর্মজীবনে পদার্পনের প্রাক্কালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকরের সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম জনাব এম. সাইফুর রহমানের সংস্পর্শে আসলে অর্থমন্ত্রী তাহার চমৎকার একাডিমিক ক্যারিয়ার দেখে মুগ্ধ হন এবং তাহকে বিসিএস কর্মকর্তা হওয়ার পরামর্শ দেন (যা মোঃ হারুণূর রশিদ স্যার কোন এক আলাপচারিতায় প্রকাশ করছিলেন)। কিন্তু একজন সফল ব্যাংক কর্মকর্তা হওয়ার দৃঢ় সংকল্প থেকে ফিন্যান্স বিষয়ে লেখাপড়া এবং ১৯৯৬ সালে এক তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাায় মেধা তালিকায় স্থান অর্জন করে ইষ্টার্ণ ব্যাংকে প্রভিশনারী অফিসার পদে যোগদান করেন। পেশা জীবনের এক পর্যায়ে তিনি ব্যাংকিং ডিপোøমা সম্পন্ন করেন। ২০০৪ সালে ব্যাংক পরিবর্তন করে যমুনা ব্যাংকে যোগদান করেন। যমুনা ব্যাংকে কর্মকালে ২০০৫ সালে যমুনা ব্যাংকের বিয়ানীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক থাকা অবস্থায় আমানত, বিনিয়োগ ও মুনাফাসহ সকল বার্ষিক টার্গেট অর্জন করাতে বিশেষ এওয়ার্ড প্রাপ্ত হন এবং ব্যাংকের আয়োজনে তিনি ২০০৬ সালে মালয়েশিয়া সফর করেন। ইহা ছিল তার দ্বিতীয় বিদেশ সফর। প্রথম বিদেশ সফর ছিল ২০০১ সালে সপরিবারে ভারত সফর । পরবর্তীতে অবশ্য ২০১২ সালে পবিত্র হজ্বব্রত পালনে সৌদি আরব সফর এবং ২০১৫ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইংল্যান্ড সফর করেন। কর্মজীবনে নিজ পরিবার, শশুরালয় এবং নিজ বিবেকেরে তাড়নায় ২০১১ সালের ০৯ ফেব্রুয়ারী সুদ ভিত্তিক ব্যাংকের চাকুরী জীবনের অধ্যায় চুকিয়ে শরীয়াহ্ ভিত্তিক ব্যাংক হিসাবে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এর লালদিঘীরপার শাখায় ব্যবস্থাপক হিসাবে ভিপি পদে যোগদান করেন। ২০১৩ সালে জোনাল সিষ্টেম চালু হলে তিনি সিলেট জোনের প্রথম জোনাল হেড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে বিজনেস প্রমোশন ও মার্কেটিং ডিভিশন এর প্রধান হিসেবে এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারী হতে জীবনের শেষক্ষণ পর্যন্ত কুমিল্লা জোনের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালের অর্ধবর্ষিকি ব্যবস্থাপক সম্মেলনের আগের দিন জুলাই মাসের ১৪ তারিখ শুক্রবার ৩.১৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেন।
সৈয়দ পরিবারে বিয়ের তীব্র আকাঙ্খা থেকে (স্যারের নিজ বক্তব্য থেকে নেওয়া) ১৯৯৮ সালে পারিবারিক আয়োজনে সৈয়দা আবিদা রহমান পপির সাথে বৈবাহিক বন্ধনে তিনি আবদ্ধ হন। পারিবারিক জীবনে তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। একমাত্র ছেলে তাহসিন ২০১৫ সালে স্কলার্সহোম স্কুল এন্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন এ+ পেয়ে এসএসসি এবং ২০১৭ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এ+ পেয়ে নটেরডম কলেজ হতে এইচএসসি উত্তীর্ণ হযে বর্তমানে গাজীপুরে অবস্থিতি ওআইসির ইন্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে বিএসসি ইন্জিনিয়ারিং কোর্সে অধ্যয়ণরত। দুই মেয়ে তামিামা ও মহিমা ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বর্তমানে ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী।
পেশাগত জীবনে মরহুম হারুণুর রশীদ সিলেট জোনালে কর্মরত অবস্থায় ব্যাংক অফিসার্স ক্লাব সিলেটের ২০১৬ এবং ২০১৭ সেশসেনর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। একজন সহকর্মী হিসেবে ৬ বছরের ব্যাংকিং জীবনে তাহাকে দৃঢ়চেতা, সৎ, স্পষ্টভাষী, বিজ্ঞ, উচ্চ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এক অসাধারণ ভদ্রলোকের অবয়বে দেখেছি। ২০১১ সালে লালদিঘীপার শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগদানকালে ইসলামী শরীয়াহ্ ভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে অনভিজ্ঞ হলেও পরবর্তীতে শরীয়াহ্ পরিপালনে তাহার দৃঢ় মনোবল শুধু ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে নয় বরং ব্যক্তিগত জীবনেও তাহাকে তাকওয়া /পরিশুদ্ধির মানের উচ্চস্তরে নিয়ে গিয়েছিল। যা দেখে আমরাও অনুপ্রাণিত হতাম।
তাহার ফ্রেন্ড সার্কেল ছিল অনেক বড় এবং প্রত্যেকের সাথে ছিল ঘনিষ্ট সম্পর্ক। বন্ধুদের আমন্ত্রনে ইংল্যান্ড ভিজিট এবং ইংল্যান্ডে তাহার সম্মানে একাধিক নৈশভোজের আয়োজনও হয়েছিল। বন্ধুদের সহযোগিতায় দেশের হৃতদরিদ্র মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ, গ্রামের মসজিদ-মাদ্রাসায় নলকূপ স্থাপন, রমজান মাসে চাল-ডাল ও ইফতারী বিতরণ ইত্যাদি কর্মসূচি তিনি প্রায়ই বাস্তবায়ন করতেন।
তিনি ছিলেন খুবই সমাজ দরদী। এলাকার কোন রোগী সিলেট আসলে তাদের দেখাশুনা করা, হাসপাতালে ভর্তি করা, ডাক্তার দেখানো, প্রয়োজনে নিজ বাসায় রাখা সহ যবতীয় কাজ তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সহিত করতেন । তাহার একক প্রচেষ্টায় তাহার এলাকার এক নিঃস্ব বিধবা মহিলার জন্য ৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে ৫০ হাজার টাকা নগদে প্রদান এবং ৪.৫ লক্ষ টাকার একটি ফিক্সড ডিপোজিট করে ঐ বিধাব মহিলার নিয়মিত মাসিক আয়ের সংস্থান তিনি করেছিলেন, যা এখনো চালু আছে ।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম সফল জিন্দেগীর এক নমুনা তার কবিতায় তুলে ধরেছিলেন এভাবে-
”যখন তুমি এসেছিলে ভবে
কেঁদেছিলে তুমি
হেসে ছিলো সবে
এমন জীবন তুমি করিও গঠন
মরণে হ্সিবে তুমি
কাঁদিবে ভুবন ।”
মোঃ হারুণূর রশিদ স্যারের সহজ-সরল জীবন-যাপন ও ইন্তেকালের পূর্ববর্তী কয়েক ঘণ্টার বর্ণনা থেকে সফল জিন্দেগীর এক আভাস পাওয়া যায়। স্যার যখন পাক-পবিত্র বদনে সালাতুল জুম’য়া আদায়ের জন্য মসজিদে অবস্থান করছিলেন এমন এক অবস্থায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান, যা যেকোন মুসলমানের জন্য খুবই কাঙ্খীত এবং আনন্দের বিষয় । আর তাইতো আমি স্যারের ইন্তেকালের সংবাদ নিশ্চিত হওয়ার পরপর শুক ও সুখের সংমিশ্রনে মোবাইলে যে টেক্সট দিয়েছিলাম তাহাতে লিখেছিলাম ”আলহামদুলিল্লাহ, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহী রাজীউন ”।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মরহুম মোঃ হারুণূর রশিদকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন এবং তাহার শোকাহত পরিবারকে সবরে জামিল নসিব করুণ এই কামনা করে শেষ করছি, আমীন, সুম্মা আমীন।
লেখক:: নুরুল আম্বিয়া চৌধুরী
এফএভিপি ও ম্যানেজার অপারেশন
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিঃ, সিলেট জোন, সিলেট ।