মুক্তমত ডেস্ক :: ‘কল্লাকাটরি’ অর্থাৎ ছেলেধরার বিষয়টি আমি প্রথমে শুনি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি। তখন আমাদের বাড়ির সবাই আমাদের খুব চোখে চোখে রাখতো। এমনকি বিকেলে মাঠে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ ব্রিজ অর্থাৎ সেতু বানানোর জন্য মাথা দরকার। তাই আমাদের মাথা কেটে নদীতে দেওয়া হবে। তারপরই ব্রিজ বানানো সম্ভব হবে। এমন কথা গ্রামজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। দেখা গেলো কোন মেহমান আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। আর এসেই ছেলেধরার বিষয়টি বলছেন। এমনভাবে গল্পগুলো বলছেন, যেন তিনি নিজে দেখেছেন মাথা কেটে নিতে। এভাবে আলোচনা এক সময় বন্ধ হয়, আমরাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরি। কেন স্বাভাবিক জীবন বলছি, তার কারণ হলো, এই আতঙ্কের মধ্যে আইসক্রিম, ফেরিওয়ালা দেখলেই দৌড় দিতাম। মাথা কাটার ভয়ে। এভাবেই ভয়ে ভয়ে দিন যেতো।
এরপর অনেক বছর গেলো সেই ‘কল্লাকাটরি’ অর্থাৎ ছেলেধরার কোন আলোচনা নাই। মানে এখন নদীতে মাথা ছাড়াই ব্রিজ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু পদ্মা সেতুকে ঘিরে সেই আলোচনা আবার শুরু হল।
আমরা সংবাদকর্মী মানুষ, সংবাদের পিছনেই দিনরাত ছুটে চলি। সেই হিসেবে ছেলেধরার এই বিষয়টি সবার আগে আমাদের জানার কথা। কিন্তু আচর্যের বিষয় হল, কিছুদিন আগে আমার এক খালা বাসার নাম্বারে ফোন দিলেন। দিয়ে সবার খোঁজখবর নিলেন, এক পর্যায়ে আমি কোথায় জানতে চাইলে বাসা থেকে বলা হয় আমি বাহিরে। তখনই তিনি আমাদের বাসায়য় ‘কল্লাকাটরি’ অর্থাৎ ছেলেধরার বিষয়টি জানিয়ে দিলেন। সাথে আরো কিছু কিচ্ছা-কাহিনী মিলিয়ে তিনি বিষয়টি উপস্থাপন করলেন। এরপরই বাসায় আলোচনা হতে লাগলো, সত্যি না কি বিষয়টা মিথ্যা।
বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির তথ্য জানতে গিয়ে ছেলেধরার সন্দেহে রেনুকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আচ্ছা রেনুকে কি ভালোভাবে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। কেউ কি জানতে চেয়েছিল কেন সে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কি তার সাথে থাকা ব্যাগ চেক করে দেখেছিল। কেউ দেখেনি? যদি কেউ দেখতো তাহলে রেনুকে এভাবে প্রাণ দিতে হতো না। উৎসাহী মানুষগুলো একটু সচেতন হলে রেনুর ছোট্ট মেয়ে আজ তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতো। ঠিক আপনার-আমার পরিবারের মতো। কিন্তু এই সমাজের কিছু অতি উৎসাহী লোক তাকে সেই সুযোগ দেয় নি। আজ যখন রেনুর মেয়েটির কান্না বারবার ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।
সন্ধ্যার পর যখনই বাসায় ফিরলাম। বাসার সবাই জিজ্ঞেস করছিল ছেলেধরার বিষয়ে। যেহেতু ছোট-ভাইবোন স্কুলে যায়, সেহেতু মায়ের চিন্তাটা একটু বেশি। আমি যথারীতি সবাইকে বুঝিয়ে আশ্বস্ত করলাম যে, এমনটা কখনও হয়নি আর হবার সম্ভাবনাও নাই। তাই ছেলেধরার বিষয়টির আলোচনা এখানেই শেষ। সম্ভবত দেশের বিভিন্ন স্থানেও বিষয়টি এভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছেলেধরার এই আলোচনায় ঘি ঢেলেছে নেত্রকোনার এক মাদকাসক্ত। সে তার এক প্রতিবেশী শিশুর কাটা মাথা নিয়ে মেথর পট্টিতে গিয়েছিল মদ কিনতে। সেখানে তার ব্যাগ থেকে ফোটা ফোটা রক্ত পড়তে দেখে লোকজন জিজ্ঞাসা করলে সে দৌড় দেয়। তখন লোকজন ধাওয়া করে তাকে ধরে গণধোলাই দিয়ে মেরে ফেলে। একজন মানুষ একটি ব্যাগে করে শিশুর কাটা মাথা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে আমাদের সমাজের অতি উৎসাহীদের বিশ্বাস বেড়ে গেল, তারা দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেললেন, এই লোক নিশ্চয়ই শিশুর মাথা নিয়ে পদ্মা সেতুতে যাচ্ছিল। তাই মাদকাসক্ত ছেলেটিকে মুহূর্তেই হত্যা করে ফেললো অতি উৎসাহীরা। তারপর গণমাধ্যমে শিশুটির কাটা মাথার ছবি বারবার দেখাতে লাগলো। তখন আবার বাসার সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়লো।
এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণধোলাই শুরু হলো। আর এসব গণধোলাইয়ে প্রাণ হারালেন পাঁচজন। গত কয়েকদিন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণধোলাইয়ে সংবাদ এলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় নি। কিন্তু যখন গত শনিবার সকালে ঢাকার উত্তর বাড্ডার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে শিশুচোর সন্দেহে তসলিমা বেগম রেনুকে গণধোলাই দিয়ে হত্যা করা হয়। আর রেনু বেগমের মৃত্যুর পর তাঁর জীবন-সংগ্রামের গল্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হল। তখনই টনক নড়তে শুরু হলো সবার। এরপর এ ঘটনায় মামলা হলো, পুলিশ ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলো। পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করা শুরু হলো। নানাভাবে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করা হলো বা হচ্ছে।
কিন্তু সম্প্রতি গণধোলাইয়ে আরো চারজনের মৃত্যু হলেও তারা আলোচনায় নেই। আলোচনায় নেই গত ছয় মাসে নানা গুজবে গণধোলাইয়ে শিকার হয়ে প্রাণ হারানো প্রায় ৫০ জনের অধিক মানুষ। (সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন) এর কারণ আমরা যে বিষয়টি ভাইরাল হয়, তার আদ্যোপান্ত জানতে চাই। এভাবে একজনের আদ্যোপান্ত জানতে গিয়ে আরেক ঘটনার জন্ম হয়। তখন আবার সেই ঘটনায় চলে যাই। এভাবেই চলছে আমাদের জীবন, আন্দোলন ও প্রতিবাদ।
যদি কিছুদিন আগের কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথমেই সেফুদা, নুসরাত, বিশ্বকাপ ও মাশরাফি, মিন্নি, প্রিয়া সাহা আর সর্বশেষ ছেলেধরা। একেরপর এক ঘটনা ঘটছে। আমরা নতুন নতুন ঘটনার দিকে ছুটছি। এভাবেই চলছে, হয়তো এভাবেই চলবে। কিন্তু আসলেই কি এভাবে চলবে। মানুষ এখন যে আচরণ করছে তা কোনভাবেই কাম্য নয়। মানুষ কোন কিছু বুঝার আগে কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই মানুষকে মেরে ফেলছে।
এই যেমন বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির তথ্য জানতে গিয়ে ছেলেধরার সন্দেহে রেনুকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আচ্ছা রেনুকে কি ভালোভাবে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। কেউ কি জানতে চেয়েছিল কেন সে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কি তার সাথে থাকা ব্যাগ চেক করে দেখেছিল। কেউ দেখেনি? যদি কেউ দেখতো তাহলে রেনুকে এভাবে প্রাণ দিতে হতো না। উৎসাহী মানুষগুলো একটু সচেতন হলে রেনুর ছোট্ট মেয়ে আজ তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতো। ঠিক আপনার-আমার পরিবারের মতো। কিন্তু এই সমাজের কিছু অতি উৎসাহী লোক তাকে সেই সুযোগ দেয় নি। আজ যখন রেনুর মেয়েটির কান্না বারবার ফেইসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। তখনই মা আমাকে প্রশ্ন করলেন কি হয়েছে। আমি ঘটনা বলার পর তিনি নির্বাক হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরপরই তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, এখন বের হলে কোথাও দাঁড়ানো যাবে না। যদি ছেলেধরা সন্দেহে গণধোলাই শুরু করে। বিশ্বাস করুন এমন প্রশ্ন শুনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এমনকি নিজের মায়ের কাছ থেকে এরকম প্রশ্ন কেউই শোনার জন্য প্রস্তুত নয় বলে আমি বিশ্বাস করি।
অথচ ‘পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে’ বলে যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। তার উত্তর পেতে আপনার শিক্ষা দিয়ে, বিবেচনা দিয়ে চিন্তা করুন। তারপর না হয় এসব বিশ্বাস করুন। আর বর্তমান যুগে আপনি গুজব বিশ্বাস করেছেন। আপনার লজ্জা লাগে না, আপনার বিবেকে একটুও বাঁধে না। বর্তমান যুগে কোন কিছু বিশ্বাস করার আগে ইন্টারনেটেও তো যাছাই-বাছাই করা যায়। সেই যাচাই-বাছাইয়ে গেলে ‘গুজব’ এর ইংরেজি হল rumour, যার অর্থ হল, জনসাধারণের সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়, ঘটনা বা ব্যক্তি নিয়ে মুখে মুখে প্রচারিত কোন বর্ণনা বা গল্প।
আমরা যারা মুখে মুখে প্রচারিত গল্প শুনে গণধোলাইয়ে শরিক হয়ে কাউকে হত্যা করছি, তখন কি মনে পরে না এটা ফৌজদারি অপরাধ। আর কারো গতিবিধি সন্দেহজনক হলেই তাকে গণধোলাই দেয়ার অধিকার আমাদের নাই। আপনার-আমার অধিকার হচ্ছে কারো উপর সন্দেহ হলে পুলিশ সোপর্দ করা। আর আপনি যদি গণপিটুনিতে কাউকে হত্যা করেন তাহলে এটা খুন এবং সম্মিলিত খুন।
লেখক: আহমদ ইমরান
গণমাধ্যমকর্মী এবং ছাত্র
ই-মেইল: ahmedemran135@gmail.com
সিলেট৭১নিউজ/২৪জুলাই/বুধবার/এআ