কোম্পানীগঞ্জ সংবাদদাতা: বোমামেশিন নামক দানবযন্ত্র দিয়ে আবারো শুরু হয়েছে কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরফিন টিলায় অবাধে পাথর লুট। স্থানীয় পাথরখেকোরা বিগত কয়েক বছর ধরে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শাহ আরফিন টিলা কেটে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বর্তমানে শাহ আরফিন টিলা হারিয়েছে তার নিজস্ব অস্তিত্ব। পরিবেশ হারিয়েছে তার ভারসাম্যহীনতা। আশপাশের শতশত একর ফসলী জমি পরিনত হয়েছে পতিত ভূমিতে। বর্ষাকালে সড়কপথে চলাচলে সাধারণ মানুষ ও স্কুল-কলেজ এবং মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি। স্থানীয় প্রশাসন রহস্যজনক কারনে রয়েছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। সবকিছু দেখেও যেন না দেখার ভান করছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। ফলে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে পাথরখেকো চক্ররা।
বোমামেশিন ব্যবহার করে অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে বিগত দিনে শাহ আরফিন টিলায় দুই দফা টিলা ধসের ঘটনা ঘটে। ওই সময় টিলা ধসের ঘটনায় মারা যান হতদরিদ্র ৬জন শ্রমিক। উক্ত ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টির পর ওই টিলায় পাথর উত্তোলন বন্ধে নজরদারি বৃদ্ধি করে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। দায়িত্বে অবহেলার দায়ে উক্ত থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ বায়েছ আলমকে প্রত্যাহার করা হয়। এমনকি বদলি করা হয় তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুম বিল্লাহকেও।
কল্পনীয় হলেও সত্য এত কিছুর পরও এখনো শাহ আরফিন টিলায় বোমামেশিন দিয়ে ও টিলা কেটে পাথর উত্তোলন চলছে অবাধে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই পাথরখেকোরা পাথর উত্তোলনে হয়ে ওঠেছে বেপরোয়া। এ অবস্থায় কিছুদিন পরপর ওই টিলায় টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালনা করে কয়েকটি বোমা মেশিন আটকের পর ধ্বংসও করা হয়েছে। আবার প্রকৃত আসামীদের আড়ালে রেখে মামলা দেয়া হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল বাছির পরিবারের বিভিন্ন নিরপরাধ ব্যক্তিদের নামে। যা উপজেলার নিয়ে উপজেলায় সংশয় ও তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে স্থানীয়রা ক্ষোভের সাথে জানান, পাথরখেকোদের এহেন কার্যকলাপের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)কে বারবার অবগত করার পরও উনারা দেখছি এবং দেখতেছি বলে ফোন রেখে দেন ।
তবে বর্তমানে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের নীরবতাকে পুঁজি করে পাথরখেকোরা প্রতিদিন বোমামেশিন নামক দানবযন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সরকার হারাচ্ছে প্রচুর পরিমান রাজস্ব।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিগত কয়েকদিন শাহ আরফিন টিলায় পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকলেও গত এক সপ্তাহ যাবৎ শাহ আরফিন টিলা ধ্বংসের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়া মূলহোতাদের নেতৃত্বে আবারো লুটপাট করা হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় অর্ধকোটি টাকার পাথর। নেতৃত্বে থাকা পাথরখেকোরা হলেন, বশির কোম্পানীর দুই কর্ণধার জিহাদ আলী ও তার ছেলে মোহাম্মদ আলী, পাথরখেকো সিন্ডিকেটের অন্যতম সর্দার জালিয়ারপাড় গ্রামের মৃত আব্দুলের ছেলে হুশিয়ার আলী, হোসেন ও সেবুল মিয়া, শুকুর আলীর ছেলে মাসুক, সাদ্দাম, আব্দুল গনির ছেলে জামায়াত নেতা ইব্রাহিম আলী ও ইব্রাহিম আলীর ভাই ইসমাইল আলী, চিকাডর গ্রামের মৃত ইউনুস আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন আনাই ও আব্দুল হান্নান এবং মৃত তসিল মিয়ার ছেলে স্থানীয় ইউ/পি সদস্য ও বিএনপি নেতা আজির উদ্দিন।
আবার শাহ আরফিন টিলায় পাথর উত্তোলনে ব্যবহৃত প্রায় ৪০টি বোমামেশিনের প্রতিটি থেকে স্থানীয় প্রশাসনের নামে আদায় করা হচ্ছে ৫/৬ হাজার টাকা করে। আর সেই টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে হুশিয়ার আলী, আনোয়ার হোসেন আনাই, আব্দুল হান্নান, ইব্রাহিম আলী ও আজির উদ্দিনের নেতৃত্বে।
শাহ আরফিন টিলার আশপাশ এলাকা অর্থাৎ ছনবাড়ী, জালিয়ারপাড়, চিকাডর ও বাবুল নগর গ্রামের নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধীক ব্যক্তিরা জানান, দীর্ঘদিন যাবৎ অপরিকল্পিতভাবে ও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পাথরখেকো সিন্ডিকেট প্রধান ও সিন্ডিকেট সর্দারদের নেতৃত্বে চলছে বেপরোয়াভাবে বোমামেশিনে পাথর উত্তোলন। শাহ আরফিন টিলার মাটি মিশ্রিত পানি ও লাল মাটি পাথরখেকোরা যত্রতত্র ফেলার কারনে আশপাশের শতশত একর ফসলী জমি আজ পতিত ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বছরে একবারও সেখানে ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না কৃষকদের পক্ষে। যে কারনে সাধারণ কৃষকরা পড়েছেন ব্যাপক বিপাকে। হাসির বদলে মুখে যেন বিষাদের ছাপ নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন কৃষকরা। রীতিমতো অজানা দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে তাদের মাঝে। শুধু তাই নয় বর্ষা মৌসুমে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক (ভোলাগঞ্জ থেকে ছনবাড়ী) চলাচলের একেবারে অনুপযোগী হয়ে পড়ে শাহ আরফিন টিলার কাদামাটির জন্য। হাজার হাজার জনসাধারণ পড়েন ব্যাপক ভোগান্তিতে। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়মিত পাঠদান করতে পারে না। যে কারনে চরম দুশ্চিন্তায় ভোগেন তাদের অভিভাবকরা। সবকিছুর জন্য দায়ী পাথরখেকোদের প্রধান ও সর্দাররা। আর তাদেরকে বর্তমানে আশ্রয় এবং প্রশ্রয় দিচ্ছেন খোদ স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সিলেটের পাথর কোয়ারীগুলোয় সব ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন আদালত। এছাড়া ইতোপূর্বে শাহ আরফিন টিলাসহ তিনটি কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। তবে এসব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই শাহ আরফিন টিলা কেটে ও বোমামেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনে চলছে মহোৎসব।
পাথরখেকোদের বেপরোয়া পাথর উত্তোলন ও পরিবেশ ধ্বংসের কারনে উপজেলার জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। যে কোন সময় উক্ত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলেও অভিমত প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।